নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্ব। সবাই এ কাজ পারে না। বা সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। ইসলামেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ আমানত বটে। একজন নেতার মধ্যে নির্দিষ্ট গুণাবলি থাকা জরুরি। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে প্রয়োজন হয় নেতৃত্বের। যোগ্য নেতৃত্বের জন্য রয়েছে কিছু মহৎ গুণ। জীবনে সফল ব্যক্তিই নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই সফল নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন বিশ্বাস, সৎকর্ম, কল্যাণকামিতা ও সহিষ্ণুতা। মহানবী (সা.) ইতিহাসের সেরা নেতা হিসেবে বরিত হন। নেতৃত্বের প্রতিটি ধাপে তিনি যে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করেন তাই তাঁকে সেরার আসনে বসাই। সভ্যতার চরম উৎকর্ষের এ যুগেও তাঁর মতো সফল নেতার দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবে না কেউই। মহানবী (সা.)এর মধ্যে সফল নেতৃত্বের যেসব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল সেগুলোর প্রতি খানিক আলোকপাত করব আজকের লেখায়। একজন নেতার ভেতর এসব গুণাবলী থাকলে তখন সে আদর্শ হয়ে উঠবে এবং ধীরে ধীরে মানুষের আস্থাভাজন হবে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সফল ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ন: আরবদের কোনো সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা সংবিধান বা সভ্যতা বিনির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিল না। সাধারণত বিভিন্ন গোত্রীয় ঐতিহ্য মেনেই পরিচালিত হতো আরবের সমাজ ব্যবস্থা। মহানবী (সা.) ই প্রথম তাদের শেখান–শূরাব্যবস্থা, সমতা, সেনাবাহিনী তৈরি করা, সামরিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বণ্টন, সুদৃঢ় গোয়েন্দাব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কোষাগার নির্মাণ এবং তার ব্যয়পরিকল্পনা, বন্দী মুক্তির নীতিমালা, স্বরাষ্ট্র ও পরারষ্ট্রনীতিসহ একটি আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার সব উপাদান।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন: একজন সফল নেতার জন্য সবার আগে এ গুণ থাকা অপরিহার্য। কারণ এর অনুপস্থিতি নেতাকে তাঁর অনুসারীদের কাছে হেয় করে তোলে। মহানবী (সা.)যে কাজের আদেশ করতেন কিংবা যে কাজ থেকে বারণ করতেন এর প্রথম বাস্তবায়নকারী তিনি নিজেই হতেন। যুদ্ধে তিনি সম্মুখে অবস্থান করে নেতৃত্ব দিতেন। অন্যকে উপদেশ দিয়ে তিনি নিজে কখনো যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছপা হননি।
মানুষের প্রতি সদয় আচরণ: সফল ও আদর্শ নেতাকে অবশ্যই এ গুণে গুণান্বিত হতে হবে। মহানবী (সা.) কথায় কাজে আচার–আচরণে সব সময় নম্রতা–ভদ্রতা ও সহনশীলতা দেখাতেন। আল্লাহতাআলা নিজেই সেই কথার স্বীকৃতি দিয়ে বলেন আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমলতা দেখান। আপনি যদি কঠোর হৃদয় ও রূঢ় স্বভাবের হতেন তবে আপনার সঙ্গীরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে পড়ত। (সুরা আল ইমরান : ১৫৯) মহানবী (সা.)সব সময় কঠোরতার পরিবর্তে সহজতা শাস্তির পরিবর্তে ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতেন।
সিদ্ধান্তে অটলতা: মহানবী (সা.)কখনো সিদ্ধান্ত নিতে কঠোরতা করতেন না। তবে যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন তখন সর্বোচ্চ দৃঢ়তার সঙ্গে সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন। কেউ তাকে টলাতে পারত না। উহুদ যুদ্ধের সময় তিনি সাহাবায়ে কেরামের কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে। মহানবী (সা.)এর মত ছিল মদিনায় থেকে যুদ্ধ করার। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবির মতামত ছিল বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার। যখন সিদ্ধান্ত হয়ে গেল তখন তিনি বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বর্ম পরে ফেললেন। তখন সাহাবিদের অনেকেই নবীজির কাছে এসে ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন।
যোগ্যদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ: সফল নেতা তাঁর অনুসারী ও সহকর্মীদের ব্যাপারে সচেতন থাকেন। প্রত্যেকের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত স্থানে বসান। মহানবী (সা.)এর মধ্যে গুণটি পূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিল। তিনি প্রত্যেককে তাঁর যোগ্যতার ভিত্তিতে দায়িত্ব দিতেন এবং উপযুক্ত কর্মক্ষেত্রের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিতেন।
আধুনিক বিশ্বের প্রয়োজন অনুসারে একজন নেতার মধ্যে থাকা উচিত এমন টপ–টেন (সেরা দশটি) বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করেন জন অ্যাডায়ার। নির্বাচিত সেই ১০টি পয়েন্ট :-
১. সৎ ও বিশ্বস্ত: জন লিখেছেন তিনি–মহানবী (সা.) যে কোনো পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এবং নবুয়ত প্রাপ্তির আগে ধীরে ধীরে নিজেকে আরবের ওই সমাজে একটি রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বকে কোনোভাবেই বিতর্কিত হতে দেননি। তাঁর প্রথম বৈশিষ্ট্যই ছিল প্রতিটি বিষয়ে সততা।
২. ভিশন বা প্রাথমিক উদ্দেশ্য: তিনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি কোনো দিকনির্দেশনা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণের সময় যদি কিন্তু এ জাতীয় শব্দের আশ্রয় নেননি। তাঁর চমৎকার একটি কৌশলী মন ছিল যার সাহায্যে ভেতর থেকে অসামান্য সুন্দর নেতৃত্ব দিয়েছেন। যতক্ষণ না তিনি সমস্ত ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক এবং অন্যান্য বিবরণ সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত না হতেন তিনি কোনো লক্ষ্য প্রকাশ করতেন না।
৩. সাহস: তিনি অবিশ্বাস্য সাহসিকতার সঙ্গে সব ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করতেন। এমনকি তার শত্রুরাও তার নির্ভীক ক্ষমতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি কখনোই কোনো কিছুতে বিচলিত হতেন না।
৪. যোগ্যতা: তিনি তাঁর ক্ষমতায় এতটাই দক্ষ ছিলেন তিনি যে পদেই দাঁড়িয়ে থাকতেন বা যে কাজই করতেন না কেন তিনি তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতিতে পূর্ণ করতেন। কখনোই তা অসমাপ্ত রেখে দিতেন না। এই কাজ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর এসব বিষয় দর্শকদের ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলত।
৫. ন্যায় ইনসাফের প্রতীক: কথাবার্তা চালচলন ও অন্যান্য বিষয়ে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। অর্থাৎ মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো ঘটনা ঘটলে তার সত্য ও ন্যায়ের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেন এবং নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতেন।
৬. সিদ্ধান্ত মূলক ব্যক্তিত্ব: সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তিনি কখনোই অস্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি দুই নৌকায় সওয়ার হতেন না (অর্থাৎ দুই ধরনের কথা বলতেন না)। তিনি সর্বদা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতেন। পরামর্শের মাধ্যমে তাঁর সিদ্ধান্তগুলো শক্তিশালী করতেন।
৭. প্রজ্ঞা: পর্যবেক্ষণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যেকোনো দৃশ্যকে চূড়ান্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখার অনন্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। যেকোনো আসন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তিনি সব সময় আগে থেকেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন।
৮. ধৈর্য ও ক্ষমা: তিনি অত্যন্ত নমনীয় এবং ধৈর্যশীল ব্যক্তি ছিলেন। প্রতিশোধের পরিবর্তে ক্ষমাতে বিশ্বাসী ছিলেন। ধৈর্যশীলতার কারণে তিনি নিজেকে সব ধরনের পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছেন।
৯. সহানুভূতিশীল এবং উষ্ণ মনোভাব: কোমল হৃদয় মৃদু ভাষা ও হিকমতপূর্ণ কথাবার্তা বলতেন। প্রশংসা করা এবং খোলাখুলিভাবে অন্যদের প্রশংসা করা তাঁর অভ্যাস ছিল। সাক্ষাতে সব সময় হাসি দিয়ে উষ্ণতা প্রকাশ করতেন। তিনি প্রতিপক্ষের কথা মনোযোগসহ শুনতেন এবং তিনি তাঁর বক্তব্য অন্যদের কাছে স্পষ্ট করতে সক্ষম ছিলেন।
১০. আধ্যাত্মিক ও মানসিক বুদ্ধিমত্তা : সর্বদা আধ্যাত্মিক এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি বুদ্ধিভিত্তিক প্রমাণ দিয়ে সমস্যা সমাধান করতেন। মানুষের মনে আশা সঞ্চার করতেন। মানুষকে অর্থপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন যাপন করানো এবং সে বিষয়ে মানুষকে বোঝানোর এক চিত্তাকর্ষক ক্ষমতা রাখতেন। এটা আমার বিশ্বাস যে রাসুলুল্লাহ (সা.)এর জীবনের একটি দিককেও সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা ও প্রশংসা করা অসম্ভব। এ ছাড়া সুন্দর আচরণ, নৈতিকতা, ধৈর্যশীলতা, বিনয়, আল্লাহভীরুতা, সত্যবাদিতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি একজন আদর্শ নেতার জরুরি গুণাবলি। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব গুণ থাকলে হওয়া যাবে আদর্শ মুসলিম নেতা।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।