ইসলামী ব্যাংকে দেড়শ কোটি টাকার এলসি পেমেন্ট আটকা

দেশের সার্বিক আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা, আমদানিকারকদের মাঝেও অস্বস্তি

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিদেশি ব্যাংকের এলসি পেমেন্ট না দেয়ায় দেশের আমদানি বাণিজ্য নিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে। জনতা ব্যাংকের পর এবার ইসলামী ব্যাংকের বড় ধরনের পাঁচটি এলসি পেমেন্ট আটকে রাখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানিকারক পণ্য পাঠিয়ে দিয়ে টাকা না পেয়ে দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। বিদেশি রপ্তানিকারক পাওনা টাকা উদ্ধারে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, চিঠির পর চিঠি লিখছেন। ইতোমধ্যে আইনজীবীর মাধ্যমেও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে চিঠি দেয়া হয়েছে। একাধিক আমদানিকারক বিষয়টিকে দেশের আর্থিক সুনামের জন্যই বড় ধরনের হুমকি বলে মন্তব্য করে বলেছেন যে, আমদানি নির্ভর একটি দেশের ব্যাংকিং খাতে এভাবে একের পর এক এলসি পেমেন্ট না দেয়ার ঘটনা দেশের সার্বিক আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এলপি গ্যাস, খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেও মূল্য পরিশোধ না করায় বিদেশি রপ্তানিকারকেরা পণ্য মূল্য পাচ্ছে না। অথচ তাদের পণ্য দেশে আমদানি করে বন্দর থেকে খালাস করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। দেশের সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের মূল্য পরিশোধের গ্যারান্টি পাওয়ার পরই রপ্তানিকারকেরা তাদের পণ্য এদেশে পাঠিয়েছেন। অথচ সরকারি বেসরকারি বেশ কিছু ব্যাংক কোটি কোটি ডলারের এলসি পেমেন্ট পরিশোধ না করে আটকে রেখেছে। বিষয়টি নিয়ে বিদেশি সরবরাহকারীরা নানাভাবে দেন দরবার করেও তাদের টাকা না পেয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা ব্যক্ত করছে। কোন কোন রপ্তানিকারক বাংলাদেশে আর কোনদিনই পণ্য পাঠাবেন না বলেও ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। জ্বালানি বা খাদ্যশষ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এমন নেতিবাচক কার্যক্রম বড় ধরনের সংকট সৃষ্টিরও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টানসহ আর্থিক সংকটের কারণে দেশে বেশ কিছুদিন সমস্যায় ছিল। কিন্তু বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে গড়ে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স আসছে। এখন দেশে ডলার সংকট প্রকট নয় বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে যে, অথচ সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলো এলসি পেমেন্ট না দিয়ে দেশের আর্থিক খাতের সুনাম নিয়ে জুয়া খেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এক মাসের মধ্যে আটকে পড়া সব এলসি পেমেন্ট পরিশোধ করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি বেশ কয়েক মাসেও। বিষয়টি নিয়ে দেশের আমদানিকারকদের মাঝেও অস্বস্তি বিরাজ করছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব জনতা ব্যাংকের প্রায় ত্রিশ কোটি টাকার এলসি পেমেন্ট না দেয়ার সংবাদ প্রকাশের পর দৈনিক আজাদীর হাতে এসেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পাবলিক লিমিটেডের ৫টি এলসি আটকে রাখার ঘটনা। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান গ্রেইন এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড (এজিই) নামের প্রতিষ্ঠানটি রাজশাহীর নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেডের কাছে ডাল জাতীয় পণ্য বিক্রি করে। ইসলামী ব্যাংকের পাঁচটি এলসি যথাক্রমে নং০৮৭৯২৪০১০৯৫৫, তারিখ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ মূলে ২.৭৭২ মিলিয়ন ডলার, নং০৮৭৯২৪০১০৯৫৬ তারিখ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ মূলে ২.৭৭২ মিলিয়ন ডলার, নং০৮৭৯২৪০১০৯৫৮, তারিখ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ মূলে ২.৭৭২ মিলিয়ন ডলার, নং০৮৭৯২৫০১০০০৮ তারিখ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ মূলে ২.৭৭২ মিলিয়ন ডলার এবং নং০৮৭৯২৫০১০০০৭ তারিখ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ মূলে ২.৯১২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, এজিই নির্ধারিত পণ্যসমূহ যথাসময়ে রপ্তানি করেছে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্রেডিট লেটারের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সকল নথিপত্র যথাযথভাবে দাখিল করেছে। এইসব নথি পাওয়ার পর ইসলামী ব্যাংক মূল বিল অব ল্যাডিং নাবিল নাবা ফুডসকে হস্তান্তর করে, যার ফলে তারা মালামাল গ্রহণ করে। এসব পণ্য বন্দর থেকে খালাস করে নেয়া হয়। এর মধ্যে কেবলমাত্র একটির অধীনে অর্থ পরিশোধ করেছেসেটি ০৮৭৯২৪০১০৯৫৫, যার অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে ২৭ মার্চ ২০২৫ তারিখে। অবশিষ্ট চারটি এলসির অধীনে আজ পর্যন্ত কোনো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি এবং ব্যাংক কর্তৃক কোনো গ্রহণযোগ্য কারণও প্রদান করা হয়নি। এরমধ্যে কেবলমাত্র একটি এলসির বিপরীতে গত ২৭ মার্চ কিছু অর্থ ছাড়া দেয়া হলেও বাকি চারটি এলসির বিপরীতে কোন অর্থ পরিশোধ করা হয়নি।

মোট পণ্যমূল্য ১৪ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৭০ কোটি টাকার খুব সামান্য একটি অংশ অস্ট্রেলিয়ান রপ্তানিকারক পেলেও দেড়শ’ কোটিরও বেশি টাকা আটকে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও সফল না হওয়ায় তিনি ইতোমধ্যে আইনজীবীর শরণাপন্ন হয়েছেন। সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম আমিনুল ইসলাম নজির ইতোমধ্যে বিষয়টি বিস্তারিত উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহে পত্র দিয়েছেন। গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে নৌবাণিজ্য আইনবিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট এম আমিনুল ইসলাম নজির বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এভাবে বিদেশীদের টাকা ব্যাংক পরিশোধ না করলে দেশের ব্যাংকিং খাত আস্থা হারাবে। যা দেশের আমদানি বাণিজ্যের জন্য বড় ধরণের হুমকি।

এর আগে জনতা ব্যাংকের এলসি পেমেন্ট না হওয়ায় দেশে এলপিজি আমদানিই হুমকির মুখে পড়ে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শীর্ষস্থানীয় এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কামজার জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি থেকে প্রায় তেত্রিশ কোটি টাকার এলপিজি আমদানি করে বাংলাদেশের গ্রিন টাউন এলপিজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জনতা ভবনের জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা গত বছরের ৩০ এপ্রিল এলসি নম্বর০১৩২২৪০২০০২৪ মূলে ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯ দশমিক ৭৫ ডলার এবং ৩০ জুন তারিখে এলসি নম্বর০১৩২২৪০২০০৩৫ মূলে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৬ দশমিক ৬৪ ডলার মিলে ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮৬৬ দশমিক ৩৯ ডলারের এলসি খোলে। জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা উক্ত এলসির পেমেন্ট দেয়ার কথা সংযুক্ত আরব আমীরাতের ব্যাংক ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংককে। উক্ত এলসি’র আওতায় আমদানিকারক গ্রিন টাউন এলপিজি সময়মতো এলপিজির চালানটি খালাস করে বাজারে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু ব্যাংক সরবরাহকারীর এলসি পেমেন্ট করেনি। গতবছরের ১৪ জুন এবং ১৪ আগস্ট উক্ত দুইটি এলসি পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে আজ নয় কাল করে করে ব্যাংক এলসি পেমেন্ট ঝুলিয়ে রেখেছে বলেও ইতোমধ্যে অভিযোগ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আজাদীতে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশের পরও জনতা ব্যাংকের টনক নড়েনি বলে অভিযোগ করে সূত্র বলেছে, এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থান ছাড়া বিদেশীদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করা কঠিন হবে।

অ্যাডভোকেট এম আমিনুল ইসলাম নজির গতরাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করার চেষ্টা করছি। দেশের আমদানি বাণিজ্য তথা দেশের ভাবমূর্তির স্বার্থেই এই ধরণের ঘটনা ঘটা উচিত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধওআইসিকে সক্রিয় করতে কাতারের জোরালো ভূমিকার আহ্বান ইউনূসের