পুরদস্তুর লড়াই শুরু হয়েছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের। গতকাল শনিবার ভোরে গাজা থেকে হামাসের নজির বিহীন মুহুর্মুহু রকেট হামলায় অন্তত ২০০ জন নিহত এবং হাজারের অধিক ইসরায়েলি আহত হওয়ার খবর জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা। তারা জানায়, হামাসের রকেট হামলার জবাব দিতে গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত ২৩২ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১৬০০’র বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। হামলার পর ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু তার দেশ ‘যুদ্ধের মধ্যে আছে’ বলে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলের নাগরিকরা আমরা যুদ্ধে আছি– কোনো অপারেশন নয়, কোনো উস্কানি নয়, একটি যুদ্ধ। সকালে ইসরায়েল ও এর নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বিস্ময়কর আক্রমণ চালায় হামাস। ভোর থেকেই আমরা এর মধ্যে আছি। নেতানিয়াহু হামাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের ঘোষণা করে বলেছেন, যুদ্ধে আমরাই জিতব।
জানা যায়, গত শুক্রবার গভীর রাত থেকে ‘প্রত্যাঘাত’ শুরু করে হামাস বাহিনী। গতকাল ভোরে ২০ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলি বসতি লক্ষ্য করে অন্তত ৫ হাজার রকেট ছোড়ে তারা। দুপুরে ইসরায়েল সরকার যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণার পরেই গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের একাধিক ঠিকানায় শুরু হয়েছে বিমান হামলা। ‘জবাব’ দিয়েছে হামাসও। গাজার সীমানা পেরিয়ে প্রায় হাজারখানেক ফিলিস্তিনি যোদ্ধা সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে। এ সময় হামাসের যোদ্ধারা হামলার পর ওই অঞ্চলে দায়িত্বরত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনাসদস্যসহ অবৈধ বসতিস্থাপনকারীদের জিম্মি করে গাজা উপত্যকায় নিয়ে যায়। পাশাপাশি, নতুন করে রকেট হামলা চালানো হয়েছে। যা সাম্প্রতিককালে নজিরবিহীন।
১৯৪৮ সালের পর গত ৭৫ বছরে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি ইসরায়েলকে। বিবিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের সম্পাদক জেরেমি বাওয়েন বলেছেন, ১৫ বছর আগে হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিলেও এমন হামলা এবারই প্রথম। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয়, কিন্তু সেগুলো মূলত জেরুজালেম থেকে শুরু করে জর্ডানের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত পশ্চিম তীরে হয়ে থাকে। তবে গতকাল সকালে হামাসের শত শত যোদ্ধা এভাবে ইসরায়েলে ঢুকে পড়বে, তা দখলদার ইসরায়েলিদের কল্পনাতেও ছিল না। এমনকি, হামাসের সদস্যরা চেকপোস্টে থাকা ইসরায়েলি সেনাদের যেভাবে গাজায় নিজেদের নিয়ন্ত্রিত স্থানে ধরে নিয়ে গেছেন, সেটিও অত্যন্ত বিষ্ময়কর।
চলতি বছরের শুরু থেকেই হামাস এবং আর একটি ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘ফিলিস্তিন ইসলামিক জিহাদ’ (পিআইজে)-এর সঙ্গে ধারাবাহিক সংঘর্ষ চলছে ইসরায়েলি সেনার। তখন থেকেই প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে গাজাকে কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ। সেই সঙ্গে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ইসরায়েল সেনার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলায় বহু সাধারণ মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার গভীর রাত থেকে প্রত্যাঘাত শুরু করে হামাস বাহিনী।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) এর পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে গাজায় ১৭টি জঙ্গি আস্তানা এবং হামাসের চারটি অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে হামলা চালানোর কথা জানানো হয়। আইডিএফ ঘোষণা দিয়েই গাজায় হামলা চালিয়েছে।
মেজর জেনারেলসহ ৫৩ জন যুদ্ধবন্দি : এদিকে হামাস দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেলসহ মোট ৫৩ জনকে ‘যুদ্ধবন্দি’ করেছে। বিষয়টি স্বীকার করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। তবে কতজনকে জিম্মি করা হয়েছে, সেটি বলেনি তারা। গতকাল ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, হামাস যোদ্ধারা কিছু ইসরায়েলিকে গাজা উপত্যকায় ধরে নিয়ে গেছে। দক্ষিণ ইসরায়েলের ২২টি এলাকায় এখনো লড়াই চলছে।
তবে আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হামাসের উপ–প্রধান সালেহ আল–আরোরি বলেছেন, তাদের হাতে যতজন ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছেন, তা ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি সব ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করতে যথেষ্ট। তিনি বলেন, আমরা অনেক ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা ও বন্দি করতে পেরেছি। লড়াই এখনো চলছে। ইসরায়েলে বন্দি ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যে হামাস নেতা বলেন, আপনাদের মুক্তি এগিয়ে আসছে। আমাদের হাতে যা রয়েছে তাতেই আপনারা মুক্ত হবেন। আমরা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। এমনকি, ইসরায়েলের স্থল আক্রমণের জন্যও প্রস্তুত রয়েছি। ইসরায়েল এখন গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। আমরা এত সহজে তাদের লক্ষ্য পূরণ হতে দেবো না। এটা কোনো চোরাগোপ্তা অপারেশন নয়। আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছি। আমার লড়াই চালিয়ে যেতে ও লড়াইয়ের পরিধি বাড়াতে চাই। আমাদের লক্ষ্য একটাই, আমাদের স্বাধীনতা ও আমাদের পবিত্র স্থানগুলোর স্বাধীনতা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।
এদিকে ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে ইসরায়েলি সরকারের পাশে থাকার কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইরান ইসরায়েলের উপর ফিলিস্তিনিদের এ হামলাকে সমর্থন করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উপদেষ্টা রহিম সাফাভি বলেছেন, আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাশে থাকবো। ইরাক, ইয়েমেন ও জর্ডানে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মিছিল হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন বলেছেন, কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়া হামাস জঙ্গিদের ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলায় ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাচ্ছে।