ইলা মিত্রের রাজনীতির সময়কাল খুব বেশী দূরের নয়। ষাট-সত্তর বড়জোর! অথচ কি অবিশ্বাস্য মনে হয়। যে রাজনীতিতে আমরা অভ্যস্ত তাতে মানুষের ভাবনার চেয়ে নিজের ভাবনাটাই বেশি। রাজনীতির অর্থ বেশ ভালোভাবেই বদলে গেছে। ইলা মিত্রের জীবনী পড়ে নতুন প্রজন্মের কেউ ভেবে বসতে পারে কোন আদর্শবান চলচ্চিত্রকারের আর্ট ফিল্মের নায়িকার চরিত্র। এমনটা চলচ্চিত্রেই সম্ভব। কীভাবে সম্ভব বৃটিশ সরকারের ডাক সাইটে কর্মকর্তা বেঙ্গল ডেপুটি একাউন্টেন্টের মেয়ে কলকাতার অভিজাত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া মেয়ে জমিদার বাড়ির বউ কি এমন দায় পড়েছিল হত দরিদ্র কৃষকের জন্য অসহায় সাঁওতালের জন্য নিজের এমন সুখের জীবনটা বিপন্ন করে তোলা? স্বেচ্ছায় জীবনের সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে এমন কঠিন জীবনের ব্রত নেওয়া?
এই অক্টোবর মাসেই এই মহিয়সী নারীর জন্ম ও মৃত্যু। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ এবং ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোরের ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বাসুটিয়া গ্রামে।
বাবার চাকরিসূত্রে কলকাতায় তাদের বসবাস। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। সময়টা ১৯৪৩ সাল। ইলা সেন কলকাতার মহিলা সমিতির সদস্য হলেন। রাও বিল বা হিন্দু কোড বিল এর বিরুদ্ধে সেই বছরেই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। ইলা সেন এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই সময় তিনি সনাতন পন্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। নারী আন্দোলনের কাজ করতে করতে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৪৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জমিদার মহিম চন্দ্রের পুত্র রমেন মিত্রের সাথে বিয়ে হলে তিনি ইলা সেন থেকে ইলা মিত্র হয়ে উঠেন। যদিও জমিদার বাড়ির বিলাসবহুল জীবন তাঁর পছন্দ ছিল না। এই জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি পথ খুঁজতে থাকেন। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি গ্রামের নিরক্ষর মেয়েদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপবাদ চালানো হয়। এই অপপ্রচার তাদের নির্যাতিত কৃষকের কাছে নিয়ে আসে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ বাংলা ১৩৫০ সনে সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপধারণ করে। এই সময়ের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে মরিয়া হয়ে উঠে কৃষকেরা। তিন ভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ইলা মিত্র সরাসরি মাঠ পর্যায়ে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকেন। ইলা মিত্র এই তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ও কৃষকের রাণী মা হয়ে উঠেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপর অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারতে চলে গেলেও ইলা মিত্রের পরিবার পাকিস্তানেই থেকে যান। ১৯৫০ সালের ৫ই জানুয়ারি পুলিশ ও কৃষকের মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ সদস্যরা নাচোলে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে এবং ১২টি গ্রামের কয়েকশ বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পুলিশের অত্যাচারে অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইলা মিত্র সাঁওতালের পোশাক পরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ভাষাগত কারণে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে রহনপুর রেল স্টেশন থেকে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার পর থেকে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। একজন নারী হিসেবেও তাঁকে সামান্যতম সম্মানটুকু দেওয়া হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইলা মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ায় তার ওপর অত্যাচারের মাত্রাটা বেশিই ছিল। ইলা মিত্রের জবানবন্দি পড়ে আঁতকে উঠতে হয়। শত অত্যাচারেও তিনি অনড় ও অবিচল ছিলেন তাঁর আদর্শের প্রতি। মুমূর্ষু অবস্থায় ইলা মিত্রকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবস্থা গুরুতর দেখে যুক্তফ্রন্ট সরকার ইলা মিত্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই সময় হাজার হাজার মানুষ ছাত্রছাত্রী শিক্ষক সাংবাদিক সুশীল সমাজ তাঁকে দেখার জন্য ছুটে যায়। শেষ পর্যায়ে তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি এদেশে আর ফিরে আসেন নি। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি চারবার পশ্চিমবঙ্গ বিধান সবার সদস্য নির্বাচিত হন। বৃটিশ শাসনবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামী আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে “তাম্রপাত্র” অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চাও করেন। “হিরোশিমার মেয়ে” গ্রন্থ অনুবাদের জন্য তিনি সেভিয়েত ল্যা-নেহেরু পুরস্কারও পান। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি এই মানবতাবাদী নেতাকে। ইলা মিত্র ইতিহাসের দুই একটি পাতা বা অধ্যায় নয়- তিনি নিজেই একটি অনন্য ইতিহাসের নির্মাতা।