ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে (শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাতে) এ হামলা চালানো হয়। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে পরিচালিত ইসরায়েলের এ হামলায় ইরানে ৭০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানী রয়েছেন। জবাবে ইরানও ১০০টিরও বেশি ড্রোন ইসরায়েলের ওপর নিক্ষেপ করেছে। ইরানের ছোঁড়া সব ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে, দাবি ইসরায়েলের।
এদিকে শুক্রবার দিনের বেলায় আবার নতুন করে দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের বিমানবাহিনী এঙে এক পোস্টে বলেছে, তারা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎেক্ষেপস্থল ও অবকাঠামোগুলোতে হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইরানের রাজধানী তেহরানে শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে বলা হয়েছে, তেহরানের আবাসিক এলাকায় হামলা হয়েছে। তেহরানের উত্তর–পূর্বাঞ্চলেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
ইরানের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরে ইসরায়েল একটি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস সংশ্লিষ্ট একটি বার্তা সংস্থা।
স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে জানা গেছে, তাবরিজে এ হামলায় অন্তত তিনজন নিহত এবং পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে অন্তত ১০টি স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। যদিও এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনীও (আইডিএফ) এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন কোনো হামলার কথা নিশ্চিত করে জানায়নি।
এদিকে ফার্স নিউজ এজেন্সি বলছে, ‘আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান অনুসারে ইসরায়েলি হামলায় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ৩২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
তেহরানের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ওমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আয়োজিত একটি বৈঠকের একদিন আগেই এ হামলার ঘটনা ঘটল। অর্থাৎ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ভেস্তে দিতেই এই হামলা। বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে রাজধানী তেহরানসহ দেশটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, দেশটির মধ্যাঞ্চলের ইস্পাহান প্রদেশের নাতানজ শহরে যেখানে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা রয়েছে সেখানে বড় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ২০০টির বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ১০০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে ৩৩০টিরও বেশি মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ইরান। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম ফেরেয়দুন আব্বাসি, যিনি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এইওআই–এর সাবেক প্রধান ছিলেন।
এছাড়া, নিহত হয়েছেন মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি। তিনি ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তেহরানের ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই তালিকায় আরও আছেন আব্দোলহামিদ মিনৌচেহর, আহমাদ রেজা জোলফাঘারি ও আমিরহোসেইন ফেকহি। এদের প্রত্যেকেই তেহরানের শহীদ বেহেশতি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। ষষ্ঠ জনের পুরো নাম এখনও প্রকাশ করা হয়নি। শুধু তার পদবী ‘মোতাল্লেবিজাদেহ’ উল্লেখ করা হয়েছে।
পরমাণু বিজ্ঞানীরা ছাড়াও নিহতের তালিকায় রয়েছেন ইরানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন– ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি ও খাতাম আল–আনবিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার ঘোলামালি রশীদ।
তেল আবিবের এক সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, তারা শতাধিক হামলা চালিয়েছেন, নিশানায় ছিল অন্তত ৮টি স্থান। তেহরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের শুরু হিসেবে এই হামলা চালাল তাদের সামরিক বাহিনী।
আল জাজিরা জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত ইরানের ছয়টি স্থানে হামলার খবর নিশ্চিত হতে পেরেছে। এগুলো হচ্ছে তেহরান ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, নাতানজ, তাবরিজ, ইস্ফাহান, আরাক ও কেরমানশাহ। এর মধ্যে নাতানজে ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা। ইসরায়েলি হামলায় ওই স্থাপনার বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বেশ কয়েকটি টেলিগ্রাম চ্যানেল দাবি করলেও তেহরানের দিক থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি। এদিকে আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, তারা ইরানের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
এদিকে তেল আবিব বলেছে, তাদের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, ইরানের যেসব বিজ্ঞানী পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজে যুক্ত, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং নাতাঞ্জের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাকে লক্ষ্য করে এই অভিযান চালানো হচ্ছে, এটা কয়েক দিন ধরে চলবে।
এদিকে, হামলার জবাবে ইরানও ১০০টিরও বেশি ড্রোন ইসরায়েলের ওপর নিক্ষেপ করেছে। ইরানের ছোঁড়া সব ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে, দাবি ইসরায়েলের।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ইরান ইসরায়েলের দিকে কমপক্ষে ১০০টি ড্রোন ছুড়লেও তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো এই ড্রোনগুলো দেশের সীমানার বাইরে থেকেই গুলি করে ভূপাতিত করছে এবং এখন পর্যন্ত কোনো ড্রোন ইসরায়েলে পৌঁছায়নি।
যদিও আইডিএফ বলছে, তারা ড্রোন হামলার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, তবে এখনো পর্যন্ত সবগুলো ড্রোন গুলি করে নামানো হয়েছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত করেনি।
ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা জারি : ইরানের ওপর ইসরায়েলিদের ‘পূর্ব–নির্ধারিত হামলা’ শুরুর পর তেহরানের পক্ষ থেকে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়ে শুক্রবার ইসরাইল জরুরি অবস্থা জারি করেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগাম হামলার পর, তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র এবং এর বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অতএব, এবং নাগরিক প্রতিরক্ষা আইনের অধীনে তার কর্তৃত্ব অনুসারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরাইল কাটজ এখন একটি বিশেষ আদেশে সই করেছেন। আদেশ অনুসারে সমগ্র ইসরায়েলরাজ্য জুড়ে হোম ফ্রন্টে একটি বিশেষ জরুরি অবস্থা জারি করা হবে।’
বিশ্বজুড়ে দূতাবাস বন্ধ করে দিচ্ছে ইসরায়েল : ইরানে হামলার পর ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী তাদের সব দূতাবাস বন্ধ করে দিচ্ছে। নাগরিকদেরকেও সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং জনসমাগম এলাকায় কোনও ইহুদি বা ইসরায়েলি প্রতীক প্রদর্শন না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলের দূতাবাসের ওয়েবসাইটগুলোতে শুক্রবার পোস্ট করা বিবৃতিতে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সামপ্রতিক পরিস্থিতিতে ইসরায়েল তাদের বৈদেশিক সব মিশন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিচ্ছে এবং কনস্যুলার সেবাও আপাতত দেওয়া হবে না। ইসরায়েলি নাগরিকরা বৈরি কোনও তৎপরতার মুখোমুখি হলে তারা যেন স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসরায়েলি দূতাবাসগুলো কতদিন বন্ধ রাখা হবে তার কোনও সময়সীমা জানানো হয়নি বিবৃতিতে।
জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস শুক্রবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, জার্মানি ইসরায়েলি বিভিন্ন স্থান এবং ইহুদিদের সুরক্ষা জোরদার করছে। সুইডেনের স্টকহোমেও গ্রেট সিনাগগের বাইরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ভবনের কাছে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ ভ্যান ও কার। বার্তা সংস্থা রয়টারসের এক সাংবাদিক এ খবর জানিয়েছেন।