দুর্নীতির একটি মামলায় আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করেছে তার দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) নেতাকর্মীরা। রাজধানী ইসলামাবাদ ও পেশওয়ারে কারফিউ জারি করা হয়েছে। আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জার্সের সহায়তায় গতকাল বিকালে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো–এনএবি ইসলামাবাদ হাই কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ইমরানকে গ্রেপ্তার করে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সাইফুল্লাহর বরাত দিয়ে জানায় দেশটির ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যম ডন। দুটি মামলার শুনানিতে উপস্থিত হতে ইমরান ইসলামাবাদ হাই কোর্টে গিয়েছিলেন। হাই কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তার গাড়ি ঘিরে ফেলা হয়। ইন্সপেক্টর জেনারেল আকবর নাসির খানকে উদ্ধৃত করে ইসলামাবাদ পুলিশ এক বিবৃতিতে বলেছে, একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির পাঁচ হাজার কোটি রুপির বৈধতা দেওয়ার বিনিময়ে কয়েকশ কোটি রুপি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইমরান খান এবং তার স্ত্রীর বুশরা বিবির বিরুদ্ধে। সেই মামলাতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম রাজনৈতিক বিক্ষোভের আঁচ পড়ল সেনার সদর দফতরে। ইমরানের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে গতকাল সন্ধ্যায় রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদরের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়েন পিটিআইয়ের কয়েকশ সমর্থক। পেশোয়ারের সেনা শিবিরে ঢুকে আগুন লাগানো হলো। করাচি সেনানিবাসেও হামলা হয়। তবে কোথাও নিরাপত্তায় মোতায়েন বিক্ষোভকারীদের আটকানোর চেষ্টা করা হয়নি। খবর বিডিনিউজ ও বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার।
পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে দলীয় প্রধানকে নির্যাতন করার অভিযোগ তুলে তাৎক্ষণিকভাবে দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। যদিও পুলিশ নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ডন জানিয়েছে, ইমরানকে আটক এবং আইনজীবীদের মারধরের অভিযোগ করে টু্ইট করেছেন পিটিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাওয়াদ চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ইমরানের গাড়িবহরকে ঘিরে ধরেছিল।
পিটিআইয়ের আরেক নেতা আজহার মাসওয়ানি অভিযোগ করেছেন, ইমরানকে আদালতের ভেতর থেকেই তুলে নেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে দলের পক্ষ থেকে এখনই নেতাকর্মীদের প্রতি রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
পিটিআই নেতা মোশাররাত চিমা টুইটারে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, তারা এখন ইমরান খানকে নির্যাতন করছে। তারা ইমরান সাহেবকে মারধর করছে। তারা খান সাহেবকে কিছু একটা করেছে। পিটিআইয়ের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে ইমরানের আইনজীবীর ভিডিও প্রকাশ করে লিখেছে, আদালতের সামনে তিনি ‘বাজেভাবে জখম’ হয়েছেন।
ইমরানকে গ্রেপ্তারের জেরে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়তে পারে আশঙ্কায় রাজধানী ইসলামাবাদে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। ইসলামাবাদ পুলিশ দাবি করেছে, কাউকে নির্যাতন করা হয়নি।
ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর করাচিসহ পাকিস্তানের বড় বড় নগরীগুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করায় গতকাল সন্ধ্যায় পেশওয়ারে আগামী ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি কমিশনার শাহ ফাহাদ।
করাচিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবর জানিয়েছে ডন। বলেছে, সেখান বিক্ষোভ দমনে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেছে। বিক্ষোভকারীরা একটি বাস ভাঙচুর করেছে। লাহোরে সেনেটর ইজাজ চৌধুরীর নেতৃত্বে পিটিআইয়ের সমর্থকরা লিবার্টি চকে জড়ো হয়েছেন। নগরীর আকবর চক, পেকো রোড, মেইন কানাল রোড ও ফয়সাল টাউনও বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে পিটিআইয়ের সমর্থকদের টায়ার পোড়াতে এবং জোট সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। ইমরানের জামান পার্কের বাসভবনের বাইরেও সমর্থকদের সরকারি ব্যানার ছিড়তে দেখা গেছে।
খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পিটিআইয়ের প্রাদেশিক প্রধান ডা. মোহাম্মদ ইকবালের নেতৃত্বে লাক্কি মারওয়াত জেলার বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। তারা টায়ারে আগুন দিয়েছে এবং সিন্ধু মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।
পিটিআই সমর্থকরা লাহোর সেনানিবাসের আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়েছে বলে টুইটারে এক বার্তা পোস্ট করে জানিয়েছেন সাংবাদিক মুর্তজা আলি শাহ। তিনি একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। যেখানে দেখা যায়, একদল মানুষ লাঠি হাতে সেনানিবাসের একটি গেট দিয়ে প্রবেশ করছেন। তাদের কারো কারো মুখ আংশিক ঢাকা দেওয়া। পরে তাদের কাউকে কাউকে লাঠি দিয়ে দেয়ালে বাড়ি দিতে দেখা যায়। সেখানে ইউনিফর্ম পরা কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল হেডকোয়াটার্সের সামনে জড়ো হয়েছেন পিটিআই সমর্থকরা। করাচিতে পিটিআইয়ের বিধায়ক ও এমপিরা রাস্তায় নামার পর শরিয়া ফয়সালের উভয় লেনেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
এর আগে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের জন্য লাহোরের জামান পার্কে তার বাসভবনে বেশ কয়েকটি অসফল অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। তবে সে সময় গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। লং মার্চে তাকে হত্যাচেষ্টায় গোয়েন্দা বাহিনীর শীর্ষ এক কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছিলেন ইমরান। সামরিক বাহিনী ওই অভিযোগ অস্বীকার করলে ইমরান গতকাল এক ভিডিও বার্তায় দ্বিগুণ জোরের সঙ্গে ওই অভিযোগ উত্থাপন করেন।
গতকাল গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ভিডিও বার্তায় কর্মী–সমর্থকদের উদ্দেশে ইমরান বলেছেন, আমার কথা আপনাদের কাছে পৌঁছানোর সময়ের মধ্যে একটি অবৈধ মামলায় আমাকে বন্দি করা হবে। সত্যের পথ থেকে পিছু হটানোর জন্য এমন গ্রেপ্তারি তৎপরতা চালানো হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, তারা আমদানি করা সরকারকে তাকে মেনে নেওয়ানোর জন্য এসব করছে। ন্যায়ের জন্য লড়তে সবাইকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান তিনি। এর পরই তাকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আটক করা হলো।
তাৎক্ষণিক এক টুইটে ফাওয়াদ অভিযোগ করেন, ইমরানকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ‘অপহরণ’ করা হয়েছে এবং আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের ওপর নির্দয় নির্যাতন চালানো হয়েছে। অজ্ঞাত লোকজন ইমরান খানকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে।
পরে এক বিবৃতিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক আকবর নাসির খান জানান, ইমরানকে আল–কাদির ট্রাস্ট মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাঞ্জাবের ঝিলুমে একটি বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে গঠিত এই ট্রাস্টের মাধ্যমে ইমরান দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। মামলাটিতে ইমরানের স্ত্রী বুশরা বিবি, ঘনিষ্ঠ সহচর জুলফিকার বুখারি ও বাবর আওয়ানের নামও জড়িয়ে আছে।