ইন্টারনেট ব্যবহারে অগ্রগতি, অপব্যবহারে বিপত্তি

রূপক কুমার রক্ষিত | মঙ্গলবার , ৪ নভেম্বর, ২০২৫ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

প্রযুক্তির এক আপডেট আবিষ্কার হল ইন্টারনেট সেবা। এ জাদুকরী সেবার কল্যাণে মানুষের হাতের নাগালেই যেন পৃথিবী! হাত বাড়ালেই নিমিষেই বিশ্বকে জানা যায়। পৃথিবীর চেহারা যেমন ক্রমে বদলে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি বদল হচ্ছে মানুষের জীবন প্রবাহের গতি। পুরাতনকে পেছনে ফেলে ক্রমশ এগিয়ে চলে নতুনের পথে, আর এ কারণেই নতুন সৃষ্টি এবং আবিষ্কারের দিকে মানুষের ঝোঁক রয়েছে আদিকাল থেকে। বুদ্ধি এবং শক্তির সমন্বয়ে দিন দিন এক নতুন জীবন চেতনার অনুসারী মানুষ ক্রমে নানা রকম আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সমাজ ও সভ্যতাকে দিনের পর দিন নতুন রূপে গড়ে তুলেছে। ডিজিটাল যুগের বিশ্বময় কল্যাণে প্রযুক্তিবিহীন জীবন যেন এখন এক অকল্পনীয় বিষয়। ইন্টারনেট ব্যবহার এ প্রযুক্তিগত বিজ্ঞানের যুগে জনজীবনে রসত যুগিয়েছে।

বাস্তবিকপক্ষে দিন দিন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশুকিশোর থেকে বয়ো:বৃদ্ধ সকলেই ইন্টারনেট ইউজার অর্থাৎ ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে সম্পৃক্ত। এ প্ল্যাটফর্মে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অফিসিয়ালসহ সর্বক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। খুব সহজেই ব্যক্তিগত ও সামাজিক যোগাযোগওে মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করা যায় এবং অফিসিয়াল জরুরি সভা বা যোগাযোগের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্দান্ত নেয়া যায়। এতে একদিকে সময় ও অর্থ উভয়ই বাঁচে অপরদিকে নুতন নুতন তথ্য ও সুবিধার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া যায়। বর্তমানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা থাকে যা কেবল মাত্র ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কাল্যাণেই সম্ভব যেখানে ইন্টারনেট একটি মূল ফ্যাক্টও। আবার অনেক শিক্ষার্থী গুগল বা ইউটিউব চ্যানেল এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষনীয় বিষয় সংগ্রহ করে থাকে। ইন্টারনেট ব্যবহার কওে শিক্ষার্থীরা নিসন্দেহে অনেক সুবিধা ভোগ করছে। এর ফলে এ সকল শিক্ষার্থীদের সকলের হাতে থাকে স্মার্টফোনল্যাপটপসহ পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা। আবার অবসর সময়ে শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের এই সুবিধা ব্যবহার করে অনলাইন ভিডিও গেমিংয়ে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটায় এবং বন্ধুদেও সাথে চ্যাটিং করে। মোটামুটি শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন সময়ের বেশ একটি সময় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট এর সাথে যুক্ত থাকে।

কিন্তু প্রযুক্তির এ কল্যাণের দেহজুড়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে নানান প্রকার অকল্যাণ। যে ইন্টারনেট সেবা গোটা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সেই ইন্টারনেট সেবা এখন মানুষের জীবনের অনেক প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানকালে ইন্টারনেট ব্যবহারে যতই বাড়ছে অগ্রগতি, এর অপব্যবহারে ততই বাড়ছে বিপত্তি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অল্পবয়সীদের অনেকেই লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে দিনে দিনে ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অন্ধকার জগতে। এদের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সর্বাধিক। অনলাইন ক্লাসের নামে স্মার্টফোনল্যাপটপসহ পর্যাপ্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হবার ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটের এই সুবিধার অপব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি। সময় কাটায় অনলাইন ভিডিও গেমিংয়ে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাছাড়া শিশুকিশোর বা শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত আসক্ত হচ্ছে ইন্টারনেটে হোয়াট্‌স আপ, ফেইসবুক, ভাইবার, ইমো, ম্যাসেঞ্জার, গুগল, ইউটিউব ও ভিডিও গেইমে। উদীয়মান শিক্ষার্থীদের এইরূপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটের সময় নষ্ট হলে আগামীতে জাতি মেধাশূন্য হয়ে নিঃসন্দেহ দুর্দশাগ্রস্ত হবে।

অপরিমিতি ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে মানুষের শরীর ও মনে নানান বিরূপ প্রভাব পড়ে যা মানুষের বেড়ে উঠার পথে বিশাল অন্তরায়। বিশেষ করে শিশু কিশোরদের মানসিক বিকাশে এ ইন্টারনেটের অপব্যবহার দিন দিন যেন ভয়ংকর পরিণতির দিকে আগাচ্ছে। একজন মোবাইল ইন্টারনেট ইউজার নোটিফিকেশন চেক বা এসএমএস চেক ইত্যাদি কারণে দিনে অসংখ্য বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিন স্পর্শ করে যার ফলে শরীর ও মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। অতিরিক্ত টাচস্ক্রিন ব্যবহারে মোবাইল থেকে নির্গত রেডিয়েশনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। শিশুদের পেন্সিল ধরার ক্ষমতা কমে যেতে পারে, যা তাদের দক্ষতা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। মেজাজ দিনদিন খিটখিটে হয় ও একে অপরের সাথে বিবাদবিপর্যয়ে জড়িয়ে পড়ে। অমনোযোগিতা ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদেরও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এমনকি চোখের দৃষ্টি শক্তির হ্রাস সহ মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়ে মানসিক ভাবে অনেকে বিকারগ্রস্ত হবারও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এতসব উৎকণ্ঠার বিষয় থাকলেও সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে দূরে রাখার সুযোগ নেই। বরং অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করা অভিভাবকদের উচিত। ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বাবামায়ের প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা দরকার এবং সন্তানের সাথে খোলামেলা আলোচনা করে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের অনলাইন আচরণ পর্যবেক্ষণ করা। ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম স্থূলতা, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এই বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অনলাইন ঝুঁকি সম্পর্কেও সন্তানদের সচেতন করতে হবে। তাদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং সময় নির্ধারণ করে স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সন্তানের অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে অপরিচিতদের সাথে অযথা অকারণে অনলাইনে টেক্সট করা বা ভিডিও চ্যাট না করা এবং ব্যক্তিগত তথ্য কারো সাথে শেয়ার না করার ব্যাপারে সতর্ক করতে হবে যাতে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়। তাছাড়া হ্যাকিং, ফিশিং, বা ডেটা চুরির মতো অনলাইন ঝুঁকিসহ ইন্টারনেট ব্যবহারের যাবতীয় নেতিবাচক বিষয় ও ঝুঁকি সম্পর্কে সন্তানদের ধারণা দিতে হবে এবং এ থেকে সুরক্ষার পরামর্শ দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মৌলিক কিছু জিনিসে পরিবর্তন এনে একটু সচেতন হলেই শিশুদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নজরদারি করা যায়। অনুকরণ প্রবণ শিশুকিশোরদের সঠিক পথে পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারে তাদের সরাসরি নিষেধ না করে তাদের শিক্ষামূলক সাইডগুলো ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ জীবনের অগ্রগতিকে সহজ ও অর্থবহ করেছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এর আলোকেই জীবনকে আলোকিত করতে হবে। অজানাকে জানার জন্য ইন্টারনেট এক উত্তম বন্ধু। এর আশীর্বাদে মুহূর্তের মধ্যে যে কোন অজানাকে জানা যায়। তবে এর ব্যবহার যথার্থ হওয়া চাই। যেনতেন ভাবে অসতর্ক হয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এ প্রযুক্তির মধুময় নির্যাস থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কোনভাবে অসতর্কতায় প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রলোভনে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে জীবনের সফলতার পথ রুদ্ধ হবে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হবে। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তির বিকৃত রূপের প্রলয়ংকরী স্পর্শে জীবন অনিবার্য ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। ফলে ফুলের মত একটি জীবন পরিপূর্ণতা না পেয়ে পথভ্রষ্ট হবে যার ফলে পরিবার, সমাজ ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইন্টারনেট ব্যবহার বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রার যুগান্তকারী মাইল ফলক। ইন্টারনেট এর কল্যাণে সারা বিশ্ব আজ এক পরিবারে পরিণত হয়েছে। এর আধুনিক ছোঁয়ায় বিশ্বের মানুষ বিশ্বকে অকল্পনীয়ভাবে উপভোগ করছে। ইন্টারনেট ছাড়া জীবনকে এখন এক মুহূর্তও ভাবা যায় না। দৈনন্দিন বৈশ্বিক জীবন পরিক্রমায় ইন্টারনেট এক গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চালক। সার্থক জীবনের সফল হাতিয়ার হিসেবে ধরা হলেও এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এর সঠিক ব্যবহারে ব্যর্থ হলে তখন এই প্রযুক্তিই মানবজাতির সম্মুখে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অগ্রসর সভ্যতার কর্মচঞ্চল আধুনিক জীবনব্যস্থায় অলস বা বিলাসী হওয়াটা এখন আর উন্নত মানব সমাজের মানদণ্ড নয়। বুদ্ধি এবং শক্তির সমন্বয়ে পরিশ্রমী মানুষ দিন দিন এক নতুন জীবন চেতনার দিকে অনুসারী হচ্ছে। ইন্টারনেট এর একটি অগ্রগামী সহায়ক শক্তি। শিক্ষামূলক উপাত্ত ও তথ্য সংগ্রহের অন্যতম দারুণ মাধ্যম। ইন্টারনেট এর পরিমিত ও সঠিক ব্যবহার উৎসাহিত করা এবং ব্যবহার বিমুখতা তৈরি করা থেকে বিরত থেকে বহুমূখী সুবিধা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে পরিশুদ্ধভাবে অগ্রবর্তী পথের সন্ধান দেয়া এখন সময়ের দাবী।

লেখক: প্রাবন্ধিক; ডিজিএম, রূপালী ব্যাংক পিএলসি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম: এক নীরব কবিতা, যার প্রতিটি পঙ্‌ক্তি হৃদয়ে লেখা
পরবর্তী নিবন্ধচতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করতে হলে সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে