ইতিহাস সৃষ্টি করা ২০২৪ বিদায় নিচ্ছে আজ

মোরশেদ তালুকদার | মঙ্গলবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। এ বছরের শুরুটা হয় রাজনৈতিক উত্তাপউত্তেজনা দিয়ে। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেই ছিল এ উত্তেজনা। সরকার পতন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ওই সময়ে আন্দোলনরত বিএনপি’সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে। দাবি আদায়ে হরতালঅবরোধ এবং ‘অসহযোগ আন্দোলন’ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল দলটি। এরপরও সম্পন্ন হয় নির্বাচন। সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার টানা ৩৬ দিনের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় তার। শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান ভারতে। বিজয় হয় ছাত্রজনতার। বাংলাদেশে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। এরপর অতিক্রম হয়েছে আরো প্রায় পাঁচ মাস। এ সময়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে এ বছর দায়িত্ব নেয়া ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার।

শুধু সরকার গঠন ও পতন নয়। নানা কারণে ২০২৪ অর্থবহ দেশবাসীর কাছে। নানা ঘটনার সাক্ষী বছরটি। ক্যালেন্ডারের পাতায় জুলাই আসে ৩১ দিনে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার কাছে এ বছরের জুলাই ছিল ৩৬ দিনের। ১ জুলাই শুরু হওয়া আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ৫ আগস্ট। আন্দোলনকারীরা বলেছিল ‘জুলাই মাসেই শেখ হাসিনার পতন ঘটাবেন তারা।’ তাই ৩১ জুলাইএর পরও আগস্ট মাসকে গণনা করে জুলাই হিসেবে। ওই হিসেবে তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় আসে ৩৬ জুলাই। যা ক্যালেন্ডারের পাতায় ৫ আগস্ট।

তবে এ বিজয় এমনি এমনি আসেনি। এ জন্য প্রাণ গেছে বহু তরুণের। গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেলের খসড়া তালিকা অনুযায়ী, সরকার পতন আন্দোলনে সারা দেশে ৮৫৮ জন নিহত এবং সাড়ে ১১ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামে প্রাণ হারান ১২ জন।

চট্টগ্রামে নিহতরা হচ্ছেনচট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র ওয়াসিম আকরাম, এমইএস কলেজ ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত, আশেকান আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ ছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তড়য়া, জুতার দোকানের কর্মচারী শহীদুল ইসলাম, রিকশাচালক জামালউদ্দিন, কাঠমিস্ত্রী মো. ফারুক, দোকান কর্মচারী মাহিন হোসেন সাইমুন, কার্টন ফ্যাক্টরির কর্মচারি মো. আলম, শ্রমিক মো. ইউসুফ, শিক্ষার্থী ইশমামুল হক, শিক্ষার্থী ওমর বিন নুরুল আবছার।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল নোমান এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. কাজী জাহেদ ইকবালের নেতৃত্বে ‘লইয়ার্স ফর এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট শক্তি, পরিবেশ ও উন্নয়ন’ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ১০০ মামলার নথি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, জুলাই অভ্যুত্থান দমাতে ঢাকাচট্টগ্রামে ৪ হাজার ৬৩৬ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অর্থাৎ আন্দোলন দমাতে কম চেষ্টা করেনি শেখ হাসিনার সরকার।

জুলাই বিপ্লবে সরকারের পতন হলেও এ আন্দোলন শুরু হয় জুন মাসে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল রেখে জারি করা পরিপত্র। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। চলতি বছরের ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট। রায় প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ দমাতে কঠোর হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। তখন প্রতিরোধ করে ছাত্ররা। ধীরে ধীরে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষও। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি, গণগ্রেপ্তারসহ কম কৌশলের আশ্রয় নেয়নি আওয়ামী সরকার। এরপরও রক্ষা মেলেনি। ছাড়তে হয় ক্ষমতা। দলের প্রধান দেশ ছাড়া। আত্মগোপনে চলে যায় শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ মাঠের বহু কর্মী।

২০২৪ কেবল আওয়ামী লীগের পতনের বছর নয়। এ বছরের ২৩ অক্টোবর দলটির ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্ন্তবর্তী সরকার।

জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের নামও। আন্দোলন চলাকালে প্রতিদিন শহরের রাজপথে ছিল ছাত্রজনতা। নিউমার্কেট, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেইটসহ সারা শহরে পদচিহ্ন রেখে গেছেন তারা। বিজয়ের পর আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে নগরের প্রধান সড়ক থেকে অলিগলির দেয়ালগুলো। নানা গ্রাফিতি এবং দেয়াল লিখনে রঙিন হয়ে ওঠে দেয়ালগুলো। আন্দোলন চলাকালে জনপ্রিয় হয়ে উঠা নানা স্লোগান স্থান পেয়েছে সেখানে। আছে গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীকে নিয়ে হৃদয়স্পর্শী কথামালা। আছে আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের রক্তেরঞ্জিত ইতিহাস। আছে আগামী দিনের স্বপ্নগুলোও।

৫ আগস্ট পুরো চট্টগ্রামে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস করে জনতা। এর পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথে নামে বিভিন্ন পেশাজীবীরা। এর মধ্যে আগস্টের শেষ সপ্তাহে চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়ে নগরে বিক্ষোভ করেছেন আনসার সদস্যরা। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরাও মাঠে নামে বিভিন্ন সময়ে। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াই প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরা।

চলতি বছর স্মরণীয় হয়ে থাকবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসেও। দীর্ঘ আইনি পথ পেরিয়ে এ বছরের ৫ নভেম্বর চসিকের ষষ্ঠ পর্ষদের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন নগর বিএনপি’র সাবেক আহবায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৪৮ ভোট দোখিয়ে নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন রেজাউল করিম। একইবছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডা. শাহাদাত ৯ জনকে বিবাদী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিন ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে এ মামলার রায় দেন। এরপর ৮ অক্টোবর ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। সর্বশেষ ৩ নভেম্বর শপথ বাক্য পাঠ করেন তিনি। এর আগে সরকার পতনের পর ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামসহ দেশের ১২ সিটি কর্পোরশনে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। পরবতীতে প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে ১৭ অক্টোবর চসিক থেকে প্রশাসক বাদ দেয়া হয়।

এছাড়া গত ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের’ মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। তার পরদিন তাকে আদালতে তোলা হয়। এদিন চট্টগ্রাম আদালতে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। হত্যা করা হয় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে।

বিদায়ী বছরে এত এত ঘটনার মধ্যেও আগামীকালের ভোর বার্তা দিবে নতুন বছরের, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের। এ নতুন প্রভাতে সবাই গেয়ে উঠবে– “আয় রে নূতন আয়, সঙ্গে করে নিয়ে আয়/ তোর সুখ তোর হাসি গান’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন, এখানে কোনো চাপ নেই
পরবর্তী নিবন্ধরমজানে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার