সত্যি পুরো জাতির জন্য এমন সম্মানজনক অর্জন স্বপ্নের মতো। স্বপ্নও সত্যি করা যায়, এই কথাটির দুর্দান্ত প্রমাণ দিলেন আমাদের নারী ফুটবল দল। প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা হিসেবে ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি জয়ী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। আমাদের দেশের মেয়েদের হাত ধরেই সুদীর্ঘ ১৯ বছর পর দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শিরোপা অর্জনের স্বাদ পেয়েছে লাল সবুজের বাংলাদেশ।
অভিনন্দন ভালোবাসা নারী ফুটবল দল। তোমাদের হাত ধরে আরো খানিকটা এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। এই জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক। আর এই ফুটবল দলে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছে আমাদের গর্বিত চট্টগ্রামের পাঁচ পাহাড়ি কন্যা। তাই আমরা গৌরবের সাথে বলতে পারি ‘আঁরার মাইয়া আঁরার গর্ব’।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইতিহাস গড়া সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের অন্যতম পাঁচ সদস্য বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ নারী ফুটবলারকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করে নিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী।
এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে দৈনিক আজাদীর ৬৩ বছর পদার্পণের গৌরবময় ক্ষণে আর একটি ইতিহাস তৈরি করলো চট্টগ্রামের গণমানুষের প্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী। আজাদী আমাদের চট্টগ্রামের মানুষের সাফল্য, সুখ, দুঃখকে প্রকাশ করে সকলের পাশে থেকে সবার আগে এগিয়ে আসে। সবসময় ভালো কাজের সাথে থাকতে চেষ্টা করে দৈনিক আজাদী।
আজাদীর এই প্রশংসাযোগ্য আয়োজন চট্টগ্রামবাসীর গণসংবর্ধনায় পরিণত হয়। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই মেয়েদের সম্মানিত করতে পারাটা অত্যন্ত গৌরবের। আর এ কাজটি সবার আগে করে দেখিয়েছে আমাদের প্রিয় আজাদী। জয়তু আমাদের ভালোবাসার আজাদী। জয়তু চট্টগ্রাম।
নগরীর প্রাণকেন্দ্র জামালখান মোড়ে ডা. আবুল হাশেম চত্বরে পাঁচ ফুটবল কন্যারা যখন জাতীয় পতাকা হাতে বিজয়ের হাসি হেসে উন্মুক্ত মঞ্চে উঠে আসেন তখন উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের মুহূর্মুহূ করতালিতে একটি শব্দ ভেসে আসছিল ‘আঁরার মাইয়া আঁরার গবর্’। আজ তাদের অর্জন সকল নারীদের অনুপ্রেরণার অংশ হয়ে থাকলো। ভাবা যায় নারীরা হেসেল থেকে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফুটবলের মাঠ অবধি।
একসময় বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। আবাহনী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলা দেখার জন্য মানুষের ভেতর কী উত্তেজনা কাজ করতো। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল ফুটবল খেলা। আমরা ভুলতে বসছিলাম ফুটবল নামক এমন মনোমুগ্ধকর খেলাটিকে। ফুটবল এমন একটি শৈল্পিক ক্রীড়া যার ফলাফল দেখার জন্য পুরো ৯০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। ফলাফল যদি সমান সমান হয় তাহলে বাড়তি আরো ৩০ মিনিট খেলতে হয়।তাতেও সমাধান না আসলে ট্রাইবেকারে গড়ায়। এত উত্তেজনাপূর্ণ মনোমুগ্ধকর ক্রীড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ২০২২ সালে এসে নারীরা এই ফুটবল খেলার হাল ধরলো শক্ত হাতে বিজয়ের সাথে। একটি দেশের উন্নয়ন অনেকটাই নির্ভর করে ক্রীড়া, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার উপর।
ফুটবলের সেই নিভু নিভু প্রদীপকে উজ্জ্বল ঝলমলে আলোয় রাঙিয়ে দিল আমাদের নারী ফুটবল দল। নারীরা ফুটবল খেলবে এমন ধারণা হয়তো আমাদের মধ্যে কখনোই ছিল না। কিন্তু সব ধ্যান ধারণাকে ভ্রান্ত করে দিয়ে এই নারী ফুটবল দল তাদের অদম্য সাহস ও পরিশ্রমের মাধ্যমে এগিয়ে গেছে সাফল্যের দিকে।
সংবর্ধনা মঞ্চে উঠে ভাঙা ভাঙা গলায় যখন তাদের অনুভূতি প্রকাশ করছিল। তখন তাদের চোখে আনন্দাশ্রু মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠেছিল। তারা বলছিল তাদের জন্য এই সংবর্ধনা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
এই প্রাপ্তি তাদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। এত মানুষের ভালোবাসা দেখে আনন্দে গর্বে খুশিতে চোখ মুখ রাঙা হয়ে উঠেছিল।
নারী ফুটবল দলে আমাদের গর্বিত চট্টগ্রামের পাঁচ পাহাড়িকন্যা হলেন মনিকা চাকমা, রূপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, এবং যমজ দুই বোন আনাই মগিনীও আনুচিং মগিনী। তাদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমা। তোমরা আমাদের চট্টগ্রামের অহংকার। তোমাদের জয় আমাদেরকে এনে দিয়েছে বিশ্বজোড়া সম্মান। তোমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সতত শুভকামনা ভালোবাসা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের অভিভাবক, সাংবাদিকতা পেশায় জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম.এ মালেক, প্রথম লায়ন্স নারী গভর্নর এবং চিটাগং উইমেন্স চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট কামরুন মালেক, দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক, নির্বাহী সম্পাদক শিহাব মালেক, জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনসহ চট্টগ্রামের আরো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক তাঁর বক্তব্যে বলেন সব ভালো কাজে আজাদী ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। আজাদীর এই অনুষ্ঠানকে নিজেদের অনুষ্ঠানে পরিণত করার জন্য তিনি চট্টগ্রামবাসীকে ধন্যবাদ জানান।
সবার বক্তব্যে একটাই আহবান ছিল পথচলা সবে শুরু। এই চলার পথে আমরা তোমাদের সাথে আছি সবসময়। এ বড় আশার কথা, বড় আনন্দের বিষয়। এভাবে সবার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি নারী ফুটবল দলকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
এখন তাদের জন্য প্রয়োজন যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। দক্ষ কোচ নিয়োগ দিয়ে সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী ফুটবল দলে পরিণত করা। ফুটবল ফেডারেশন যেন তাদের পাশে থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। এই যে নারী ফুটবল দল আজ বিশ্বজয়ী হয়ে নিজেদের ঘরে ফিরলো তার পেছনের ইতিহাস কিন্তু খুব একটা মসৃণ ছিল না।
মূলত কলসিন্দুর বিদ্যালয় নারী ফুটবল দলের আঁতুড়ঘর। এই বিদ্যালয় থেকে নারী ফুটবল দলের পথচলা শুরু হয়। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষকদের কাছে জাতি কৃতজ্ঞ। আজ এ নারী ফুটবল দলের হাত ধরে বাংলাদেশের বিজয় মুকুট অর্জিত হয়। এ অনন্য সাধারণ অর্জনের সাথে জুড়ে আছে ‘আঁরার চট্টগ্রামের পাঁচ মাইয়া। ইতারা আঁরার চাঁটগার গর্ব’।
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল হয়ে উঠেছে ক্রীড়া নৈপুণ্যের এক অনবদ্য প্রতীক। তাদের হার না মানা লড়াকু মানসিকতা নতুন প্রজন্মের মধ্যে অদম্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে। এই বিজয় আগামী প্রজন্মের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আবদ্ধ শক্তিশালী মানসিকতাসম্পন্ন খেলোয়াড় সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ-এর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের উত্তরোত্তর সাফল্য ও অব্যাহত জয়যাত্রা প্রত্যাশা করি। ফুটবলসহ ক্রীড়াঙ্গনের সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। জয়ীতাদের পাশে আছে দেশের সর্বস্তরের জনগণ। এগিয়ে চলো সৌরভে গৌরবে মাথা উঁচু করে।
লেখক : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক