ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

| বুধবার , ১৪ মে, ২০২৫ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ ৯ বছর পর আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন, যা বিশ্বের ইতিহাসে একক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমাবর্তন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গায়ে গাউন, মাথায় টুপি, হাতে সনদবিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত উপভোগ করতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এতে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকছেন প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপকও। তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হবে। সভাপতিত্ব করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহ্‌ইয়া আখতার।

আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আজ প্রথমবারের মতো নিজ জেলা চট্টগ্রামে আসছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রামের জনগণ প্রধান উপদেষ্টা তাদের বিশ্ববরেণ্য কৃতীসন্তানকে স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। যিনি ক্ষুদ্রঋণের পথপ্রদর্শক ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত। প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানাতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁর পৈতৃক বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামের পাশে অবস্থিত। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫ম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগদানের পাশাপাশি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জোবরা গ্রামও পরিদর্শন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এ গ্রামেই তিনি তাঁর প্রথম ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন।

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৫৮ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক জ্ঞানীগুণীর জন্ম হয়েছে। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক আলাউদ্দিন আল আজাদ, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক মুর্তজা বশীর, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নানসহ বহু কীর্তিমান মনীষী জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ‘বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রাম বিভাগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চট্টগ্রামের অধিবাসীরা স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সম্মেলনে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সভাপতির ভাষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার কথা উপস্থাপন করেন এবং একই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ভূমি কিনেন। দুই বছর পর, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ চেয়ারম্যান বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। তবে নানাকারণে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যে আন্দোলন তিনি গড়ে তুলেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের স্থান হিসেবে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজকে সম্ভাব্য ক্যাম্পাস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের জনশিক্ষা উপপরিচালক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম ওসমান গণিকে চেয়ারম্যান এবং ড. কুদরাতখুদা, . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এম ফেরদৌস খান ও ড. মফিজউদ্দীন আহমদকে সদস্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশন সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিমপট্টি মৌজার নির্জন পাহাড়ি ভূমিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে সুপারিশ করে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রাক্তন কিউরেটর ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে (এ আর মল্লিক) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।’

সমাবর্তন অনুষ্ঠান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের কাছে এ অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবেগের ও মর্যাদার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দেশের এই শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫৮ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে মাত্র ৪টি! এবার ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এতো শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে সমাবর্তন, বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হোক। শিক্ষকসহ যেকোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।’ আমরা মনে করি, বিগত সময়ে যতসব উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার করালগ্রাসের বলয় থেকে মুক্ত থেকে সদর্পে অগ্রসর হবে বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা চাই, উপাচার্যের নেতৃত্বে ও ছাত্রশিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হোক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে