১৫ আগস্ট। হাজার বছর ধরে এই তারিখে বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক ও শোকার্ত হিসাবে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলবে।
১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট শুক্রবার সুবেহ সাদেকের সময় সেনাবাহিনীর একটি ঘৃণিত চক্র কর্ণেল রশীদ-ফারুকদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি-সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নব গঠিত একমাত্র রাজনৈতিক দল ‘বাকশাল’-এর চেয়ারম্যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শহীদ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে নিরস্ত্র অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার সময় নিরস্ত্র থাকলে তিনি শহীদ বলে গণ্য হন।
একই সাথে ঘাতকরা শহীদ বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, তাঁদের তিন পুত্র শেখ কামাল ও সুলতানা কামাল, শেখ জামাল ও রোজী জামাল, ১১ বছর বয়সের শিশু শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আরও হত্যা করে এক মন্ত্রী ও মন্ত্রী পদমর্যাদায় বাকশালের তিন সম্পাদকের একজন সহ সর্বমোট ১৯ জন আত্মীয়স্বজনকে।
আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শহীদ শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও তার প্রতিবাদে সেদিন বাংলার রাজপথ-জনপথ জনতা প্রকম্পিত হয়নি, রক্ত যেমন ঝরেনি তেমনি অশ্রুপাতও দৃশ্যমান হয়নি। অথচ ১৫ আগস্টের সুবেহ সাদেকের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত বাংলার আকাশ-বাতাসে বঙ্গবন্ধু যেখানে আমরা আছি সেখানে ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছে। আর ভোর হতে না হতে বাতাসের সাথে তা হারিয়ে গেল।
রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী বাকশাল যুবলীগের প্রধান তোফায়েল আহমদ, বাকশালের তিন সদস্যের মন্ত্রী পদমর্যাদায় সম্পাদকের অন্যতম সদস্য আবদুর রাজ্জাক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রী ও বাকশালের মহাসচিব ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, সেনাপ্রধান জেনারেল কে. এম. শফিউল্লাহ বীর উত্তম প্রমুখ কোন প্রতিরোধ, প্রতিহত ও প্রতিবাদ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। কিন্তু কেন? এর উত্তর আগামী বংশধর কি খুঁজে পাবে ?
বঙ্গবন্ধু শহীদ শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে মু্ক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এস এম আফজলের (মন্ত্রী, পূর্ব পাক ৪৮-৫০/ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৬৪-৬৬) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বিরোধীদলের নেতাদের সভায় তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা উত্থাপন করলে উপস্থিত অন্যান্য দলের নেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এই ৬ দফা দিয়ে তিনি স্বাধীনতার পথে ধাবিত হন।
৬৬-র ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৫৩-৬৬) বঙ্গবন্ধু শহীদ শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশ্যে সমগ্র জাতির কাছে তাঁর ৬ দফা দাবির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে তা বাস্তবায়নে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ৬৬-র ১৯ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা দাবী প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দলের সভাপতি (১৯ মার্চ’ ৬৬-২৫ জানুয়ারি ’৭৫) তাজউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক (১৯ মার্চ ৬৬ – মে ’৭৩) নির্বাচিত করা হয়। ২০ মার্চ পল্টনে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভায় সভাপতির ভাষণে ৬দফা দাবী উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করেন। ২১ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে ১ম পৃষ্ঠায় “অতৃপ্ত শ্রোতৃমন্ডলীর শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ সিক্ত পরিবেশ ৬ দফার প্রবক্তাদের যাত্রা শুরু” শীর্ষক ব্যানার হেড লাইন সংবাদ হিসেবে পরিবেশিত হয়।
১৯৬৬-র ২০ মার্চ হতে জাতির জনক ১৯৭১-র ৬ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে উদ্বুদ্ধ করেন। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে প্রায় দশ লক্ষ জনসমাবেশে অত্যন্ত সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে সুস্পষ্ট ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করে ২৬ মার্চ বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ও যুদ্ধ ঘোষণার জন্য ১৯৭০-র ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে বিজয়ী হয়ে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা হিসেবে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুকে যে রবার স্ট্যাম্প দিয়েছিল এটাই ঐতিহাসিকভাবে মহাসত্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শহীদ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে শেষ দেখা ও কথার স্মৃতিটুকু নিয়ে আমি বেঁচে আছি। ১৯৭৫-র ১৪ জুন শনিবার বেতবুনিয়া যাওয়ার পথে গহিরাস্থ শেখ মুজিব গণ-পাঠাগারের সামনে রাষ্ট্রপতির গাড়ীর বহর থেমে যায়। এটাকে পূর্ব নির্ধারিত থামা নয়। গাড়ীর পথ আমরা আটকাইনি। গাড়ী হতে দরজা খুলে বিশাল দেহ নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রপিিত আমাদের নেতা জাতির পিতা বের হয়ে এলে বিস্মিত হয়ে যাই। পাঠাগারের সভাপতি হিসাবে তাঁকে সালাম জানিয়ে স্বাগত জানাই। সমবেত পাঠাগারের কমিটির সদস্য, সাধারণ সদস্যবর্গ ও ক্ষুদ্র জনসমাবেশ উল্লাসে ফেটে পরে। পাঠাগারে কত বই আছে সদস্য ও গ্রামবাসীরা পাঠাগারে আসে কিনা ইত্যাদি খোঁজ নেন। আমি “তাদেরকে দোয়া করছি” বলে গাড়ীতে ঢুকে পড়েন – বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন। পাঠাগারের সামনে সম্পূর্ণ সাদা-কাপড়ে আচ্ছাদিত একটি গেইট দিয়ে ছিলাম। হলুদ ব্যানারে লালকালিতে লেখা ছিল ‘খোশ আমদেদ’ লও সালাম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – শেখ মুজিব গণপাঠাগার এর কিছুদিন পর রাষ্ট্রপতি কার্যালয় থেকে ৭ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পাঠাগারের নামে তাঁর বরাদ্দকৃত ৫ (পাঁচ) হাজার টাকার চেক গ্রহণের জন্য বলা হয়।
চিঠি অনুযায়ী ১৯৭৫-র ৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় গণভবনে পৌঁছালে এক কর্মকর্তা চিঠিটি দেখে রাষ্ট্রপতির চেম্বারে যেতে ঢুকিয়ে দেয়। মহান নেতার পায়ে ধরে সালাম করে পরিচয় দিলে তিনি উচ্ছ্বাসভরা ভরাট কণ্ঠে বলে উঠেন ‘তোরত সাহস কম না। তুইতো আমাকে মালা দিলি না – কিছু চাইলিও না। এ লাইব্রেরীটা চলে কেমনে। জবাবে বলি এটি সম্পূর্ণভাবে ৭২ সাল হতে আমার ব্যক্তিগত অর্থে চালাই। কারো থেকে চাঁদা গ্রহণ করি না, কারণ ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আঁকড়া। ঢাকাস্থ প্রখ্যাত চার্টার্ড একাউনটেন্ট এম এম আহমদ এন্ড কোং কর্তৃক অডিটকৃত অডিটের একটি কপি সাথে নিয়েছিলাম তা বিনয়ে েসাথে তাঁর হাতে তুলে দিই তিনি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখেন। তিনি গম্ভীরভাবে বলে উঠলেন পাঠাগারের জন্য এই ক্ষুদ্র টাকাটুকু দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলি ? বলি-না নেতা ভারতে যাইনি তবে দেশে থেকে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। মৌলভী ছৈয়দ আহমদ ও ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন আহমদের (এমপি ৮৬-৯০) বিশেষ গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেছি। আমার ঘরে মুক্তিযোদ্ধা কেসি-২ এর অস্ত্রশস্ত্র রাখতাম, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতাম। এদের সাথে কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। অক্টোবরে শেষের দিকে আমার এক বন্ধু সামসুল আলম সহ আমাকে পাকিস্তানী আর্মিরা আমার বাসা থেকে নিয়ে সেনানিবাসে বন্দী করে অকথ্য নির্যাতন চালায়। … আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেই যে ৬৯’র ৩১ জুলাই তার সাথে এনএসএফ নেতা ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাবুবুরল হক দুলন ও তৎকালীন ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী সহ আমি তাঁর বাসভবনে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাদের বয়সের কারণে ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে মূল রাজনীতিতে যোগ দেয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন এবং সেই উপদেশকে হৃদয়ঙ্গম করে ’৭০-র ১ জানুয়ারী ছাত্র রাজনীতি হতে অবসর নিয়ে চট্টগ্রামের এম.এ. আজিজের (সাধারণ সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-৭১/ এমপি- ১৯৭০-৭১) কাছ হতে সদস্য পদ নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। ১১ দফা আন্দোলনের চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ সদস্যের একজন ছিলাম বলে উল্লেখ করি। ইতিমধ্যে চা বিস্কিট কলা এলো। এই মহান নেতার চোখ-মুখ দেখে বুঝতে পারলাম যে তিনি খুব খুশী হয়েছেন। উপদেশ দিলেন গ্রামে-গঞ্জে পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তুলতে। দেখলাম নেভীর পোশাক পরা একজন অফিসার এসে তাঁকে কোন এক কর্মসূচির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াতে আগামীতে একবার আসিস কথা বলব। খোদা হাফেজ – বলায় পায়ে ধরে সালাম করে ফিরে আসি। সেই ’৭৫-র ৭ আগস্ট হতে এই দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে এই মহান নেতার সাথে আবার কখন দেখা হবে – তার কথা বলবেন এই আশায় বসে আছি।
১৯৮১-র ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ শোক দিবস পালন করছিল চট্টগ্রামে। সেদিন সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে আওয়ামী পরিবারের শিশুপুত্র কন্যাদের এক সমাবেশে আমি প্রধান অতিথি তখন মহানগর আওয়ামী লীগ আহ্বায়ক কমিটির দপ্তর সম্পাদক আর আমার কন্যা জেবু-উন-নিসা বকর চৌধুরী লিজা (বর্তমানে চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার সেলিম আহমদ চৌধুরীর সহধর্মিণী) বক্তৃতা করেছিল। তার বক্তৃতা শুনে শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত আমার স্কুল জীবনের বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মুহাম্মদ চৌধুরী কেঁদে দিয়েছিল যা আজও আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠে এবং সেও প্রায় সময় ঐ সভার কথা বলে থাকেন। ঐদিন বিকেলে রাইফেল ক্লাবে মহানগর যুবলীগের সভাপতি নঈমুদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে যুবলীগের আলোচনা সভায় আমি প্রধান বক্তা এবং সন্ধ্যায় একই স্থানে মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় সভার পরিচালক ও মূলবক্তা ছিলাম যা ৮১’র ১৬ আগস্ট দৈনিক আজাদীর প্রথম পৃষ্ঠায় বের হয়েছিল।
৭৫-র ১৫ আগস্ট আমি গহিরা গিয়ে শেখ মুজিব গণপাঠাগারে গিয়ে জাতীয় পাতাকা অর্ধনমিত করে ৭ দিনব্যাপী শোক পালনের লক্ষ্যে পাঠাগার ৭ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা স্বস্বাক্ষরে নোটিশ দিয়ে এসেছিলাম। সেদিন আমার পাশে ছিল সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান, সম্পাদক-মুহাম্মদ ইলিয়াস, সহ-সভাপতি মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ হাসান চৌধুরী, পাঠাগার সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মুহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী ও পাঠাগারের দারোয়ান মরহুম কবির আহমদ। ১৯৯০ পর্যন্ত শেখ মুজিব গণ-পাঠাগারের সভাপতি ছিলাম।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে সংগ্রাম গড়ে তুলতে গিয়ে বিশ্বাসঘাতক সহকর্মী চক্রান্তে ১৯৭৭-র ১৭ আগস্ট সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়ে বন্ধুবর বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম শহর অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রথম জীবন দিয়েছিল, চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ আসামীর মূল আসামী।
আল্লাহ পরিবারসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শহীদ শেখ মুজিবুর রহমানকে বেহেস্ত নসিব করুক।
লেখক : জীবন সদস্য-বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২-৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।