কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার দাপটে অস্পষ্ট হয়ে পড়া কাল, স্থান ও ব্যক্তি বা বস্তুর পরিচয় বহনকারী বিষয় ও ঘটনাবলীর তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য তথা প্রকৃত রূপ খুঁজে বের করার নামই ইতিহাস গবেষনা। অন্যদিকে বর্তমান জীবনাচরণ, ঘটনা, অবস্থা, অবস্থান, স্থাপনা, আবিষ্কার সহ যাবতীয় কিছুর বর্ণনা আজ ও ভবিষ্যতের জন্য লিপিবদ্ধ করার নাম ইতিহাস রচনা অথবা ইতিহাস চর্চা। পরিশ্রম, সময়সাপেক্ষ, আর্থিক সঙ্গতি নির্ভর এই সুকঠিন ইতিহাস চর্চা ও গবেষণার কাজগুলো সারাজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাওয়া একজন মানুষ ছিলেন আহমদ মমতাজ।
বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য জাতীয় অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন বার এট ল’ এর একটি উদ্ধৃতি নিম্নরূপ :
“সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ইতিহাসের উপর গবেষনা হচ্ছে। আমাদের দেশে ইতিহাস চর্চা বিকাশেন জন্য এটা এক প্রশসংসনীয় পদক্ষেপ। আমাদের গবেষকদের মধ্যে সারা বাংলা ভিত্তিতে ইতিহাস রচনার প্রবণতা প্রবল। এতে দোষের কিছু নেই। গবেষনা যত বেশি হবে আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার ও মনের দিগন্ত তত প্রসারিত হবে। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত নিবিষ্টতার কারণে কী গবেষনায় কী পাঠ্যসূচিতে আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। এর ব্যাপ্তি সম্বন্ধেও আমাদের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। অথচ ইতিহাস–বিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে তো বটেই, দেশের ইতিহাস, বিশেষত সাংস্কৃতিক ইতিহাস বুঝতে পারা, ব্যাখ্যা–বিশ্লেষন করা ও সমৃদ্ধ করার উপায় হিসেবে আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষনা, অধ্যয়ন ও অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির মূল উপাদান, ভিত্তি ও প্রেরনা আবহমানকালের গ্রাম বাংলা। সাহিত্য ও কবিতায় গ্রাম বাংলাকে দেখা গেলেও ইতিহাসের পাতায় তার স্থান নেই। অথচ বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, সাহিত্য ও সাংস্কৃতি গ্রামভিত্তিক। পারিপার্শিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের সামাজিক রীতিনীতি ও আচার–ব্যবহার, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবনধারাও এক নয়। এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের অভিন্নতা ও বিভিন্নতা এবং সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের এই বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসন্ধান, উদ্ঘাটন ও সমন্বয় করে বাংলার যে ইতিহাস রচিত হবে, তা–ই বাংলার এবং বাঙালী সংস্কৃতির খাঁটি, পুর্ণাঙ্গ ও প্রামানিক ইতিহাস।”
অ–ভারতীয় লেইনপুল লিখেছিলেন, ভারতের সাধারণ মানুষের ইতিহাস নেই। ফলে উপমহাদেশের ইতিহাস পরিণত হল নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ঘটনার ধারাবাহিক একটি নীরস ও একঘেঁয়ে বিবরণ।
আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার জন্য প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তি কে? বাকেরগঞ্জের ইতিহাস রচয়িতা স্বনাদধন্য আই.সি.এস অফিসার হেনরি বেভারিজ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, “My own idea has been that the proper person to write the history of district is one who is a native of it, who has loved all his life in it and who has abundance of leisure to collect information. It is only a Bengali who can treat satisfactorily of the productions of his country, of its social condition-its caste, leading families, peculiarities of language, customs etc.”
অন্যদিকে ইতিহাসবিদ শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সালাউদ্দীন আহমদ এর মতে – “বিশেষ করে বাংলাদেশে নিজের বা পরিবারের খ্যাতি/অর্জন বড় করে দেখা এবং অপরের খ্যাতি বা অর্জনকে খাটো করে উপস্থাপন করার প্রবণতা অনেক বেশি হওয়ায় প্রকৃত বা ঐতিহাসিক সত্য তথ্য সংগ্রহ বড়ই কঠিন”।
নিজ ছাত্র, খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ কর্তৃক রচিত নিজ উপজেলা বাঁশখালীর একটি ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ এর প্রবল ইচ্ছা ও অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমিরেটাস প্রফেসর ড. আবদুল করিম ‘বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নামক একটি বই রচনা করেন। যেটি ১৯৯৭ সালে আমি নিজে প্রকাশ করি। এই বইতে গ্রাম ভিত্তিক মৃত শিক্ষক, লেখক, কবি. মুন্সি, উকিল, ডাক্তার, চেয়ারম্যান, মেম্বার প্রমুহ খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নাম পাঠানোর জন্য তৎকালীন বাঁশখালীর ১৫ ইউনিয়নের ১৫জন চেয়ারম্যান বরাবরে (১৯৯৫–১৯৯৬ সালে গদিনসীন) চারমাসে ৩টি চিঠি পাঠানো হলেও কারো কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায় নাই। বই প্রকাশের পর তাদের এলাকার যোগ্য লোকদের নাম বইতে যুক্ত না হওয়ার অজুহাতে আমাদেরকে তুমুল সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অথচ তাঁরা তথ্য সরবরাহ না করার জন্যই বইতে এই অসম্পূর্ণতা থেকে যায়।
২.
আহমদ মমতাজ এর সাথে আমার পরিচয় এবং যৎকিঞ্চিত আনাগোনা তাঁর জীবনের শেষ বিশ বছর আগ থেকে। তখন চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষনা ও রচনা করার আয়োজনের জন্য কয়েক যায়গায় ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি বৈঠক হয়। ড. আবদুল করিম স্যারের পরামর্শে সাবেক এম.পি রফিকুল্লাহ চৌধুরীর পুরুহিত্যে ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস রচনা প্রকল্প’ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়। যার সভাপতি মনোনীত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের সাবেক উপাচার্য শ্রদ্ধেয় ড. আর আই চৌধুরী স্যার। সেই কমিঠিতে আমাকে কোষাধ্যক্ষ করা হয়েছিল। করিম স্যার ও আর আই চৌধুরী স্যারের মৃত্যুর পর এই সংগঠনটি গতি হারায়। অতপর বলাকা প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী জামাল আহমদের আয়োজনে কবি অরুণ দাশ গুপ্ত সহ একটি বৈঠকে শ্রদ্ধেয় ড. মইনুদ্দীন খাঁন স্যারকে সভাপতি ও গবেষক আহমদ মমতাজকে সাধারন সম্পাদক করে অন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় (এটাতে আমি সহ–সভাপতি)। সিনিয়র পদধারী কয়েকজন সদস্যের অসহযোগীয় মনোভাবের কারণে এই কমিটিও কালে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু সুখের বিষয় আহমদ মমতাজ নিজের ব্যক্তিগত তাড়নাবোধ থেকে নিজ উদ্যোগে অর্থাৎ নিজে নিজেই তাঁর সামর্থ ও পরিসরে গবেষনা কর্ম চালিয়ে যান। ইতিমধ্যে তিনি ‘মিরসরাইর ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি’ নামে ৮৭৯ পৃষ্ঠার বিশাল একটি বই প্রকাশ করেন যা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় যে আঞ্চলিক ইতহাস সংগ্রহে তাঁর নিষ্ঠা, দক্ষতা, ধৈর্য ঈর্ষনীয়।
আহমদ মমতাজ তাঁর সহধর্মীনি কবি রাইহান নাসরীন কে সাথে নিয়ে দশ দিনের তথ্যানুসন্ধান সফরে বের হয়েছেন। তার একটি খুবই সংক্ষিপ্ত বর্ণনার শুধুমাত্র টিকাগুলো নিম্নরূপ –
ঢাকা থেকে গিয়ে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে রাত্রি যাপন, পরের দিন যাত্রা শুরু এবং এক এক করে এতা যায়গায় ঘোরা, কতো মানুষের সাক্ষ্য গ্রহন, কতো জনের সাক্ষাৎকার গ্রহন, বাঁশখালীর টৈটং, পুঁইছড়ি, পেকুয়া, রাজাখালী, চকরিয়া, রামু, কঙবাজার, বাকখালী, কুতুপালং, কুতুবদিয়া, উকিয়া ইনানী, চেনছড়ি, টেকনাফ, কঙবাজারের সার্কিট হাউজ, বান্দরবানের কুমারী, পরিচিতের আন্তরিক আতিথেয়তা, পুঁইছড়ির হাজেরা বেগমের(৯৫) সাক্ষাৎকার, রাজাখালীর সাম্পান মাঝি ইসলাম(১০৭) সাক্ষাৎকার, সারাদিন কাজ করে রাতে সার্কিট হাউজে কলা খেয়ে রাত্রি যাপন, মৎস কর্মকর্তা দেলোযার হোসাইন, রামুর বাংকুট মন্দিরে বাচ্চাদের সাথে আড্ডা, ফরেস্টের বাংলোয় নেমন্ত্রন, আবদুল্লাহ চাচার বাড়িতে রাত্রি যাপন, ইনানী ফরেস্টের বাংলোতে বঙ্গবন্ধুর আত্মগোপন কালীন অবস্থানের স্মৃতি ঘেরা যায়গায় রাত্রি যাপন, বনের পশু পাখির গল্প সহ বন্ধু নয়নের খাবার পরিবেশন, চেনছড়িতে ফোলারম খোয়াজার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাসের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ঘুরে ঘুরে দেখা, কিংবদন্তী জমিদার মালেকাবানুর চৌফলদণ্ডী, খুরুশকুল কুতুবদিয়া ঘুরে দশ দিন পর কঙবাজার থেকে আবার ঢাকা রওয়ানা।
এই দুরন্ত দুর্দান্ত তথ্যানুসন্ধানী জুটির তথ্য সংগ্রহের অভিযানের ক্ষীপ্রতা নিশ্চয় সহজে এইরূপ ২/৪ বারে সৃষ্টি হয়নি। কিংবা ৮/১০ বার করে তিনি ক্ষান্ত হন নি। তথ্যানুযায়ী দেখা যায় জীবনে তিনি প্রায় ৫০ বার এইরূপ অভিযানে বের হয়েছেন। তাতে গ্রামাঞ্চলের কতই না তথ্য তুলে এনেছেন, তা প্রকৃত ঝানু গবেষকদের পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব।
আরো উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের পাঠ্যসূচিতে আহমদ মমতাজের ৩টি বই অন্তর্ভূক্ত আছে/পড়ানো হয়।
মিরসরাইর ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি প্রকাশিত –২০০৪, চট্টগ্রামের সুফি সাধক – প্রথম খণ্ড প্রকাশিত – ২০০৪, চট্টগ্রামের সুফি সাধক – দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত – ২০০৫
অহর্নিশ কর্মপাগল আহমদ মমতাজ তাঁর জীবদ্দশায় বড় ছোট সর্বমোট প্রায় ৩০টি বই লিখেছেন এবং প্রকাশ করেছেন। এর বাইরেও তাঁর এক বিরাট সংগ্রহ ভাণ্ডার এখনো অপ্রকাশিত আছে। আনন্দের বিষয় এই যে, তাঁর কর্মসারথী স্ত্রী কবি রায়হান নাসরিন এসব প্রকাশের জন্য সযতন প্রচেষ্টায় আছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনকি কলেজের একজন শিক্ষকের অন্যতম নির্ধারিত কাজ গবেষনা করা। অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনার জন্য বিষয় ভিত্তিক গবেষনা একান্ত প্রয়োজন। কথায় আছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার যায়গা নয়, গবেষনার উদার ক্ষেত্র।
শিক্ষকরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষনা করে গবেষনা কাজে ঋদ্ধ হবেন এবং উপবিষ্ট শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের গবেষনা উপস্থাপন করবেন এবং তাদেরকে গবেষনা পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে গবেষনা কাজে উদ্বুদ্ধ করবেন। যার মাধ্যমে সৃষ্টিকুল প্রজন্মের জীবণ ধারনের উত্তর উত্তর দ্রুত উন্নতি সাধিত হতে পারে। কিন্তু দূঃখের বিষয় কোন প্রকারে ডিগ্রি নেয়ার নেহায়েত স্বল্পতম গবেষনা ও অনুসন্ধান ছাড়া প্রকৃতপক্ষে নেশা ভিত্তিক গবেষনার কাজ তুলনামুলকভাবে আজকের বিশ্ববিদ্যালয় সমুহে একেবারে অনুপস্থিত বললেও অত্যুক্তি হবে না। যে ক্ষুদ্র সংখ্যক নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক গবেষনায় নিয়োজিত আছেন তাঁদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংখ্যা তুলনায় গড়পড়তায় আনা অন্যায় হবে। চলমান এই অবস্থাতে অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মের কাছে আহমদ মমতাজ একজন বিরল উদাহরণ হতে পারে। গবেষনা জগতের নির্ধারিত কোন ব্যক্তি, কর্মী বা পেশাদার না হয়েও তিনি নিজ আগ্রহ, নেশা ও অদম্য পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন সার্বক্ষনিক গবেষক হিসেবে নিজেকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর অনুসন্ধান, তথ্য ও প্রকাশনার ভাণ্ডার অনেক বড়। একজন অপেশাদার নিষ্ঠাবান এই গবেষকের আপাত স্বীকৃতি স্বরূপ জতির অন্যতম প্রধান গবেষনা কেন্দ্র বাংলা একাডেমি তাঁকে সহকারী পরিচালকের পদে ভূষিত করেছেন। তাই এই কথা নির্দিধায় বলা যায় যে, আহমদ মমতাজ বাংলাদেশের সাহিত্য ও ইতিহাস গবেষনার এক বরপুত্রই বটে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা–সংগঠক।