১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরবর্তী প্রায় ২০০ বছরের (১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭) ব্রিটিশ শাসন ছিল খুবই ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ১০০ বছর শাসন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৫৮ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণায় ভারতের শাসনভার সরাসরি ন্যস্ত হয় ব্রিটিশ সরকারের হাতে, যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ১৮৫৮ সালের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত–সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাক্ট ও আইনের (ভারত শাসন আইন ১৮৬১, ১৮৯২, ১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫) মাধ্যমে এ অঞ্চলে শাসনতান্ত্রিক বিকাশ ঘটে।
পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে কমপক্ষে দুইটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছিলো এবং সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করে (বাংলায়)। এরপর ১৯৪৬ সালে ঘোষিত ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তাব করা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতকে স্বাধীনতা দিবে। এতে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনটি শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল সৃষ্টি করা হবে। প্রথম অঞ্চলে থাকবে বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশসমূহ। দ্বিতীয় অঞ্চলে থাকবে বাংলাভাষী তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা ও আসাম প্রদেশ সমূহ। তৃতীয় অঞ্চলে থাকবে ভারতের বাকি সব অঞ্চল। এতে বলা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব হবে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও যোগাযোগ, মানবাধিকার, মুদ্রা ব্যবস্থা, বহিঃশুল্ক ও পরিকল্পনা। বাকি সব দায়িত্ব থাকবে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক সরকারের হাতে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রদেশগুলো আঞ্চলিক সরকারের দায়িত্ব নির্ধারণ করবে। এই ব্যবস্থা চলবে ১০ বছর। তবে কোনো অঞ্চল এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হলে, সে অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা ও এর প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষা করার অধিকার থাকবে। মুসলিম লীগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ প্রস্তাব মেনে নেয়। কংগ্রেসও আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু কংগ্রেসের নতুন সভাপতি নেহেরু দাবি করেন, সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে সংসদ গঠিত হবে, তারাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে এবং গৃহীত ক্যাবিনেট মিশনের সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলক নয়। এর ফলে মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। তবে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে ভারতকে অভিন্ন রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
এদিকে ১৯৪৬ সালে মাউন্ট ব্যাটেন যখন মিত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়ে সিংগাপুর আসেন তখন তার সাথে পরিচয় হয় নেহেরুর। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেনে নবনির্বাচিত শ্রমিক দলের সরকার ভারত থেকে যতশীঘ্র সম্ভব ব্রিটিশ শাসন নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রত্যাহারের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে ভারতের সর্বশেষ ভাইসরয় হিসাবে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে নিয়োগ দেয়। তার দায়িত্ব ছিলো ১৯৪৮ সালের মধ্যে ভারতের স্বাধীনতা প্রদানের ব্যবস্থা করা। মাউন্টব্যাটেন খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন ভারত বিভক্তি ছাড়া শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ভারত বিভক্তির প্রধান অন্তরায় হলো কংগ্রেসের বিরোধিতা। গান্ধীর সমর্থন ছাড়া এ বিরোধিতা অপসারণ সম্ভব নয়। আর গান্ধীর সমর্থন পেতে হলে নেহেরুকে রাজি করাতে হবে। তখন এই কাজে সবচেয়ে বড় নিয়ামকের ভুমিকা পালন করেন মাউন্ট ব্যাটেনের রূপসী স্ত্রী এডউইনা।এডউইনার সাথে ছিলো নেহেরুর একটা বিশেষ সম্পর্ক। পরবর্তীতে এডউইনার ভুমিকায় ভারতের বিভক্তি সম্ভব হয়। কিন্তু সেটি ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন অনুযায়ী না হয়ে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুসারে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে করা হয়। ফলে বাংলা ও আসাম নিয়ে আলাদা দেশ হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায় ও বাংলা স্বাধীন হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯৪৭ সালের মধ্য অগাস্টে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দেশভাগের সময় বাংলাকে দুই ভাগ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলাকে (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার নতুন নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান। শুরু থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের ব্যাপক ঘাটতি ছিল। সংবিধান প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণে নতুন রাষ্ট্র গঠনের ৯ বছর অর্থাৎ ১৯৫৬ পর্যন্ত পাকিস্তান ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো। ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও এর কার্যকারিতা ছিল মাত্র ২ বছর ৬ মাসের মতো। ১৯৬২ সালে সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে আরেকটি সংবিধান তৈরি করা হয়। এর দ্বারা গণতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তে সেনা–আমলা কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। তাই একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য আন্দোলন চলমান ছিল। এর ধারাবাহিকতায় ’৬২–এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬–এর ছয় দফা কর্মসূচি এবং ’৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই নির্বাচনের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নতুন গণপরিষদ ও সংবিধান প্রণয়ন করা। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ‘সাংবিধানিক ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর‘৭১ পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরদিন ১১ জানুয়ারি তিনি একটি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এই আদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে ওয়েস্ট মিনস্টার ধরনের সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেন। অস্থায়ী সংবিধান আদেশ বলে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অস্থায়ী সংবিধান আদেশে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের একটি সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন। এই আদেশ অনুসারে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৩০ জন সদস্যকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনের দ্বিতীয় ও শেষ দিন ১১ এপ্রিল ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। তৎকালীন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে এ কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়। কমিটিকে ১৯৭২ সালের ১০ জুনের মধ্যে খসড়া সংবিধান জমা দেওয়ার কথা বলা হলেও ১১ অক্টোবর কমিটির শেষ বৈঠকে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উপস্থাপন করেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চূড়ান্ত পাঠ শেষে ৪ নভেম্বর সংবিধানসংক্রান্ত বিলটি গণপরিষদে গৃহীত হয়। যা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ‘বাংলাদেশ সংবিধান’ হিসাবে কার্যকর করা হয়। আর এর সাথেই শুরু হয় নিজস্ব সংবিধান দিয়ে বাংলাদেশের পথচলা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট