ইতিহাসবিদ আসমা সিরাজুদ্দীন স্মরণে

মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান | রবিবার , ২ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসমা সিরাজুদ্দীন গত ২১ ডিসেম্বর ভোরে চাঁন্দগাও আবাসিক এলাকার তাঁদের নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। যুব বৃদ্ধ পরিচিত সবার মুখে একই কথা আসমা সিরাজুদ্দীন ম্যাডাম উদাহরণতুল্য নিরহংকারী, মমতাময়ী, সুভাষীনি এক মহীয়সী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
২০১৬ সালে এপ্রিলের কোনো এক বৃহস্পতিবার আমাদের প্রিয় ‘আলমগীর স্যার’ ফোন করে বললেন, “তোমাকে জানাতে দেরি হয়ে গেছে, সময় থাকলে কাল শুক্রবার সকাল দশটার সময় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার হলে আস, একটি অনুষ্ঠান আছে। স্যারের দশটা মানে দশটা-ই। কোনভাবেই দশটা এক মিনিটও নয়। একটু দেরি হওয়ার কথা স্যারকে বলে রেখেছিলাম। দশটায় অন্য একটা প্রোগ্রাম সেরে দশটা পনের মিনিটে যখন হলে ঢুকলাম দেখি হলঘর কানায় কানায় ভরপুর। প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিদগ্ধ পণ্ডিতগণ। চট্টগ্রামের এবং সেই সাথে ঢাকা, রাজশাহী থেকে আগত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান এবং সাবেক অনেক ভিসি মহোদয়গণ উপস্থিত রয়েছেন। ডানে বায়ে চোখ ঘুরিয়ে একটি আসন খালি খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল ড. আলমগীর স্যারকে এক ব্যতিক্রমধর্মী সংবর্ধনা প্রদানের। সংবর্ধনা উপলক্ষে স্যারের জীবন বা কর্মের ওপর কোন রকম লিখা বা গ্রন্থ প্রকাশ করা হয় নি। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপর ত্রিশ জন দেশ সেরা পণ্ডিতের লিখা ৫৮৩ পৃষ্ঠার এক অসাধারণ সংকলন বের করেছিলেন অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হক। সংকলনটির নামকরণ ছিল- ‘Bangladesh: History, Politics, Economy, Society & Culture – Essays in honor of Professor Alamgir Mohammed Sirejuddin’, (published by UPL) ।
আলমগীর স্যার উঠলেন বক্তব্য রাখতে। যথারীতি কাগজে টুকে নেয়া বক্তৃতার বিষয়বন্তু থেকে হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি উপরে তুলে বললেন, “পরিচিত মহলে আমার একটা বদনাম আছে, আমি নাকি সব সময় ভারি কথা বলি। হাসি কৌতুক করার বিষয়টি জীবনে শিখিই নি। কৈফিয়ৎ এর জন্য নয়, তবে আজ একটু এর ব্যতিক্রম করি। এই যে আমার পাশে যিনি বসা আছেন তিনি আমার সহধর্মিণী অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দীন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোয়স’-এ পড়তে গিয়ে পাকিস্তানি এক বন্ধুর সাথে পরিচয় হই। তাঁর সাথে সখ্য জমে উঠে। তিনি আমার সিনিয়র। একদিন তিনি তৈরি হয়ে হীথরো বিমান বন্দরে যাচ্ছেন পাকিস্তান থেকে আসা তাঁর বোনকে রিসিভ করার জন্য। জিজ্ঞেস করলাম আমিও কি তোমার সাথে এয়ারপোর্টে যেতে পারি? তিনি ‘হ্যাঁ’ বললে তাঁর সাথে গেলাম এবং তাঁর বোনকে আমরা দু’জনে রিসিভ করলাম। কিছুদিন পর ঐ ভদ্রলোক পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর বোনকে সামনে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কোন প্রয়োজন পড়লে যেন তাকে একটু সাহায্য করি এবং তার তত্ত্বাবধান করি। এ বিষয়ে তিনি তাঁর বোনকেও আমার ব্যাপারে অভয় দান করলেন। সেদিনের সেই মুহূর্তে যে মানুষটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলাম, পঞ্চাশাধিকাল পার করলেও সেই দায়িত্ব আজো বয়ে বেড়াচ্ছি। এর প্রমাণ, আজও তাকে নিয়েই আপনাদের সামনে বসেছি।” স্যারের এই কথার পর তুমুল করতালি। অন্যদিকে স্যারের বর্ণনার সময় ম্যাডাম দীর্ঘ সময় ধরে রুমাল দিয়ে আনন্দাশ্রু মুছছিলেন। এই ছিলেন আমাদের আসমা ম্যাডাম।
আলমগীর স্যারের সাথে আমার প্রায়শ কথা হয়, মাঝে মধ্যে বাসায়ও যাওয়া আসা হতো। ‘স্যার’ তো ‘স্যার’ই। কিন্তু ম্যাডাম, তিনি তো ‘মায়ের জাত’। তাঁর আন্তরিকতা, সহজ সরল ব্যবহার যারা উপভোগ করেছেন একমাত্র তারাই বুঝতে বা বর্ণনা করতে পারবেন। ২০১৯ সালে ম্যাডাম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে খবর পেয়ে স্যারকে প্রথমে টেলিফোন করেছিলাম। সবিস্তারে বর্ণনার পর বুঝলাম ম্যাডামকে নিয়ে তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন এবং ব্যস্ত। কিন্তু স্যারকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলবো তাও ভয় লাগে। তিনি তো গভীর দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ সহকারে সব বুঝেন। সব কথার শেষে বললেন, “তোমার ম্যাডামের জন্য দোয়া করিও, আমি তোমাকে খবর জানাবো। তোমরা ঘনিষ্ঠ কয়জনকে নিয়ে আমি ভরসা করি।”
ম্যাডামকে ফিজিও থেরাপি দিতে হতো। এক প্রকার ভালই উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু ঘোর করোনা কালে বৃদ্ধ বয়সের দরুণ ম্যাডামের সাথে ডাক্তার, নার্স বা আয়াদের সংস্পর্শ এড়ানোর জন্য হাসপাতালে আনা নেয়া করতে চান নাই। আবার বাইরের কারোর ঘরে প্রবেশও সমীচীন মনে করেন নি। কিন্তু স্যারের কথা থেকে জানতে পারি নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়াও তাঁর একান্ত বন্ধু শ্রদ্ধেয় ডাঃ রবিউল হোসেন সাহেবের সাথে নিত্য পরামর্শ করে ম্যাডামের চিকিৎসা চালানো হচ্ছিল। যখনই প্রয়োজন পড়েছে ইম্পেরিয়েল হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দিয়েছেন। কোন কোন সময় সেখানে অবস্থান করেছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, স্যার সব সময় সাথেই থেকেছেন।
একদিন স্যার আবেগ আপ্লুত হয়ে বললেন, “আমার জন্য দোয়া করিও যাতে আমি তোমার ম্যাডামের হায়াত পর্যন্ত অন্তত বেঁচে থাকি। যেহেতু আমি ছাড়া এদেশে তার কোন রক্তের আত্মীয় নেই। সুতরাং আমিই তার একমাত্র ভরসা। আমার জন্য তো আমার অনেক আাত্মীয় স্বজন আছে।”
এই অসুস্থতার সময় স্যার নিজ হাতে ডালিম আপেলের রস তৈরি করে যত্ন সহকারে ম্যাডামকে খাওয়াতেন। বাসায় কয়েকজন আত্মীয় স্বজন থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই স্যার এসব কাজ করতেন। নিজ হাতে ম্যাডামকে ধুয়ে দিতেন। স্যারের সূক্ষ্ম বর্ণনায় ম্যাডামের অবস্থা বুঝে নিতে আমার মোটেও অসুবিধা হতো না। কোনদিন কতক্ষণ ঘুম হচ্ছে না হচ্ছে, ঘুম না হওয়ার কারণ কি হতে পারে, দিনে কয়বার কিভাবে খাবার ও ওষুধ খাওয়াচ্ছেন এসব সবিস্তারে বর্ণনা করতেন।
স্যার সারা জীবন যেই রুটিন অনুযায়ী লেখা পড়া করতেন তা এই আড়াই বছরে মোটেই করতে পারেনি। এই সময়কালে তিনি তাঁর সারা জীবনের অভ্যাস রাস্তায় নেমে ‘সকাল সন্ধ্যা’ ভ্রমণ করা থেকে বিরত থেকেছেন। স্যারের ভাষায়, স্ত্রীকে বিছানায় অসুস্থ রেখে তিনি কিভাবে সৃজনশীল কাজ করবেন। যা পরোক্ষভাবে ম্যাডামের প্রতি অবহেলা অযত্নের পরিচয় বহন করবে।
স্যার কথায় কথায় স্মৃতিচারণ করতেন – “তোমার ম্যাডাম আমার সব লিখা যত্নসহকারে কম্পিউটারে টাইপ করে দিত। লিখা দিতে দেরি হলে তাগাদা দিত।” কথা প্রসঙ্গে স্যার একবার বলেছিলেন, তিনি একটি বই লিখেছেন যেখানে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আন্দোলন, পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পূর্বাঞ্চলের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ ও এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার স্বাধীকার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের সহিংসতা এ সবের আক্ষরিক বর্ণনা আছে। বইটির পুরোটাই ম্যাডাম নিজেই সানন্দে কম্পিউটারে কম্পোজ করেছেন। কী মহীয়সী মহিলা! সতীর্থ জীবনসঙ্গীর প্রতি কি অপরূপ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
অন্যদিকে একমাত্র সন্তান ওমর সাহবের বক্তব্য, “শারীরিক ফিটনেস টিকিয়ে রাখার জন্য আমি সাইকেলে চড়ে অফিসে যাই। একবার আমি এই সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হই। সবাই আমাকে সাইকেল ছাড়তে বললেন। কিন্তু মা বলেন সাইক্লিং ছাড়িও না, ওজন বেড়ে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে। দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সাইক্লিং চালিয়ে যাও। মা আমাকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইংলিশ স্কুলে বা ক্যাডেট কলেজে পড়তে দেন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ স্কুল ও কলেজের পাঠ চুকিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছেন। আমার চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদেরকে আমি দীর্ঘ সময় অবস্থানের জন্য আমার সাথে আমেরিকা নিয়ে যেতে পারি নাই। মা বলতেন, ‘পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে এদেশে এসে শিক্ষকতা করে আমি প্রায় ৩৫ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে কাটিয়েছি, এখানে থেকেই আমি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি। সুতরাং এই বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরেই আমাদের জীবন’।” উল্লেখ্য, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা ওমর সিরাজুদ্দিন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের – ‘ম্যানেজার, গ্লোবাল পলিসি মেকিং ও এসডিজি মনিটরিং’ হিসেবে ওয়াসিংটন ডিসিতে কর্মরত আছেন। হাদীসে আছে স্বামীর হাতে/সাক্ষাতে মৃত্যুবরণ করা একজন ‘নারী’ ভাগ্যবান। অন্যদিকে বলা হয়েছে স্ত্রীর মৃত্যুর পর যে স্বামী চোখের পানি নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন বা দোয়া করেন সে নারী অবশ্যই জান্নাতবাসী। আমরা শুভানুধ্যায়ীরা ম্যাডামের জন্য স্রষ্টার নিকট জান্নাতবাস প্রার্থনা করি। আমিন, সুম্মা আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজব্রতী

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমহেশখালী জেটিতে লাভ পয়েন্ট উদ্বোধন