ইট ভাটার অনাচার: সরেজমিন পর্যবেক্ষণ

মহসীন কাজী | শুক্রবার , ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:০৮ পূর্বাহ্ণ

শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ছিল আমার বাবার ১৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী। সঙ্গতকারণে যেতে হয়েছিল গ্রামের বাড়ি। যেখানে চিরঘুমে শায়িত আছেন বাবাসহ মুরুব্বিরা। দিনটি ছিল তপ্ত, দুপুরে ভ্যাপসা গরম।

গরমে বাড়িতে মন বসছিল না। তাই ছোটবেলার বন্ধু কামালকে নিয়ে ঘুরতে বের হই। গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি থেকে নাজিরহাটকাজীরহাট ( রামগড় রোড সেকশন) হয়ে অটো রিকশা চেপে যাচ্ছিলাম সোজা উত্তর দিকে। উপজেলার অন্যতম প্রধান সড়ক হলেও বাহনের তেমন কোলাহল নেই। প্রায় ফাঁকা রাস্তায় চলছিলাম।

ছায়া সবুজশ্যামলীময় গ্রাম, ঝিরিঝিরি বাতাস, ভালোই লাগছিল। বাতাসের উষ্ণতার মাঝে শো, শো করে চলছিল আমাদের অটোরিকশা। প্রায় তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর ওমর কাজীর বাড়ি ফেলে সড়কের বাঁকে চোখ আটকে যায়। হঠাৎ করে মন মোছড় দিয়ে উঠে। মাত্র দুই তিন ফুট জায়গা রেখে সড়ককে এমনভাবে কাটা হয়েছে, যেন পড়ে পড়ে অবস্থা। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, মাটি কাটার যন্ত্রের কোপ। অন্তত ১৫/২০ ফুট খাড়া গর্ত নয়, যেন এক পুকুর। যার মাধ্যমে গিলে ফেলা হয়েছে সড়ক ধার, যাকে বলা হয় ফুটপাত। আশপাশ মিলিয়ে দেখলে মনে হবে আস্ত একটি পুকুর। পাশে বিশাল মাটির ঢিবি। ওপাশে মাটি কাটার যন্ত্র তখনও চলছিল। চারদিকের অবয়ব বলে এটি একটি ইট ভাটা। বুঝতে বাকি রইলো না, ইট ভাটার মাটি জমা করতে গিয়ে সড়কের বুকও কেটে নিয়েছে।

অনুসন্ধানী মনে জাগছিল নানা প্রশ্ন। দেখেই বুঝা যাচ্ছিল ইট ভাটাটি অনেক পুরনো। আগামী মৌসুমে ইট তৈরির জন্য আবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভাবলাম, আইন মানলে এখানে ইট ভাটা হয় কী করে। আশপাশে প্রধান সড়ক ছাড়াও আছে জনবসতি, স্কুল, মসজিদ আর ফসলের মাঠ। তার উপর নির্দয়ভাবে কোপ পড়েছে সড়কে। এসব ভাবতে ভাবতে সঙ্গে থাকা বন্ধুকে বললাম ফেরার পথে যেন এখানে দাঁড়াতে মনে করিয়ে দেয়।

ঘণ্টা দুয়েক উত্তরে ঘুরে আবার দক্ষিণে ফেরার পালা। কোম্পানি টিলা ফেলে বামে বাঁক। যে বরাবর সড়কের বুকে যন্ত্রের কোপ। এখানে এমনভাবে খোড়া হয়েছে যাতে রয়েছে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি। সড়কটি পুরোপুরি চালু হলে এটি হবে মরণ ফাঁদ। তার উপর আগামী বর্ষায় সড়কটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন স্পষ্ট। অথচ এটিই হবে চালুর অপেক্ষায় থাকা রামগড় স্থল বন্দরের অন্যতম প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। মাথায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে খেতে থামলাম সেখানে।

পড়ন্ত বিকেল তখন। সূর্য পুরো পশ্চিমে হেলেছে। সড়ক কেটে এমন নির্মমতায় যে কাউকে ভাবাবে, থমকে যাবেন। ছবি তোলার উপযুক্ত আলো। অন করলাম মোবাইল ক্যামেরা। ক্ষত বিক্ষত সড়ক ধরে বিভিন্ন অ্যাংগেলে দিলাম কয়েক ক্লিক। ছবি তোলা দেখে মাটির ঢিবি থেকে বেরিয়ে আসলেন একজন। কি যেন বলতে চাইছিলেন। আমার খেয়াল সেদিকে নেই। মাটি কাটার যন্ত্রসহ আরেক ক্লিক দিতে দিতে চালকের কাছে জানতে চাইলাম, এভাবে রাস্তা কাটার কারণ। জবাব দিলেন না। চালকের দৃষ্টি ছবি তোলার দিকে। মুখে কথা নেই। আর তাকালাম না ওদের দিকে। সোজা ফিরলাম আমার গন্তব্যে।

শহরে ফিরে পরদিন ভাবলাম কী করা যায়! সে ভাবনা সে কাজ। সড়কের মাটি ইট ভাটায় নেওয়ার কাহিনি ছোট করে লিখে ছবি আপলোড। তারপরের ক্লিকে সেটি হয়ে যায় ফেসবুক স্ট্যাটাস। এ স্ট্যাটাসের পরের ঘটনা আমার ফেসবুক বন্ধুদের জানা।

সড়কের বুক কেটে পুকুর বানিয়ে ইট ভাটায় মাটি নেয়ার এই ছবি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তোলে। স্ট্যাটাসটি দ্রুত শেয়ার হতে থাকে। এভাবে বিষয়টি নজরে আসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ২২ অক্টোবর স্ট্যাটাস দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায় এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারিং টিম। পরদিন সকালে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মালিককে না পেলেও আদালত অপরাধের প্রমাণ পেয়ে উপস্থিত ম্যানেজারকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেই যেন দায়িত্ব শেষ করেন। মামলা কিংবা প্রতিষ্ঠান সিলগালা কিছুই করেননি। এতদিন রহস্যময়ঘুমে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরও যেন হালকা জাগে। হালকা পরিদর্শন করলেও তাদের কোনো অ্যাকশন নেই। যাত্রাপথে ইট ভাটা অনাচারের যে দৃশ্য আমার চোখে ধরা পড়ে তা বলতে গেলে সামান্যই। আরও করুণ চিত্র আছে ফটিকছড়ির ইট ভাটাকে ঘিরে। এসব দেখে কিভাবে নীরব খাকলো কর্তৃপক্ষ সেটা ভাবাবে আরও গভীরভাবে।

গ্রামের নাম পাইন্দং। এখানে ইট ভাটার সংখ্যা বেশি। হারুয়ালছড়ি, ভূজপুর, পাইন্দং তিন ইউনিয়নের সীমানাবর্তী পাইন্দংয়ের উত্তর সীমানায় এক কিলোমিটারের মধ্যে আছে ছয়টি ইট ভাটা। এখানকার একটি ইট ভাটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হালদা নদীর ভেরীবাঁধের মাটি কেটে হালদাকেও গিলতে বসেছে। এই সীমানার আরেক ইট ভাটার নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে একটি বটগাছ। গাছটির চারপাশের বিশাল এলাকার অন্ততঃ ১৫ ফুট মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গাছটি ইট ভাটার নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে। হালদা আর বটগাছের এই করুণ ছবি ইতিমধ্যে আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছি। ছবি দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন সচেতন মহল। অনেকে ফোন করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

আমাদের হারুয়ালছড়ি একটি নয়ানাভিরাম গ্রাম। এ গ্রামকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও নয়নাভিরাম রাঙাপানি চা বাগান। এখানে যাওয়ার পথে চা বাগান ঘেঁষে লম্বাবিলের লোকালয় আর প্রাইমারি স্কুল এলাকায় চোখে পড়ে পাশাপাশি দুটি ইট ভাটা। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি আছে আরও তিনটি।

প্রতি বছর শীতকালে এ গ্রামসহ এলাকার ইট ভাটা এলাকায় সূর্যের দেখা মেলে না। দিনের বেলাও ইট ভাটার ধোঁয়ায় আকাশ থাকে গুমোট। আর আশপাশের গাছগাছালিও হয়ে যায় ক্ষীণকায়। পাতায় সতেজতা নেই। গ্রামের বাড়ির আম, কাঁঠালসহ মৌসুমী ফলের ফলনেও প্রভাব লক্ষণীয়। আমের ফুল ঝুড়ে যায়, মুকুল আসে না। পাশাপাশি সিমসহ রবিশস্য আবাদেও ঘটে ব্যাঘাত।

পরিবেশ আইনের কোনো ধারায় বিধি সম্মত নয় এসব ইট ভাটা। পরতে পরতে লঙ্ঘিত হচ্ছে আইন। আইনে যা আছে তার উল্টোটাই হচ্ছে এসব ইট ভাটায়। কেস স্টাডি হিসেবে এখানে ফটিকছড়ির চিত্র তুলে ধরা হলেও চট্টগ্রামজুড়ে চলছে এমন অনাচার।

ইট ভাটার প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে মাটি। প্রতি শুষ্ক মৌসুমে মাটি সংগ্রহের নামে চলে আরেক অনাচার। ভাটা মালিকের অথের্র টোপে স্থানীয় মাস্তানদের মাধ্যমে সাবাড় হচ্ছে কৃষি জমির টপ সয়েল। ইট ভাটা প্রবণ এলাকা ছাড়াও আশপাশের গ্রামের কোনো কৃষি জমি অবশিষ্ট রাখছে না তারা। এতে ফসলী জমির ফলন কমছে দ্রুত। পাশাপাশি আশপাশের মানুষের রোগবালাই তো আছেই। চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টের রোগ লেগেই থাকে।

প্রশ্ন আসতে পারে, কিভাবে চলে আসছে এই অবৈধ কর্মযজ্ঞ। জবাব একটাই ম্যানেজকরে। এ কারণে নাকি স্থানীয় ছোটবড় প্রায় সকল জনপ্রতিনিধি, দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন নীরব। আবার ক্ষেত্র বিশেষে অনেক ইট ভাটার মালিকই খোদ জনপ্রতিনিধি।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ফটিকছড়িতে যে ইট ভাটা সড়কের বুক কেটে পুকুর বানিয়ে ফেলেছে সেটির মালিকও নাকি এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি। তার নাকি আরও ইট ভাটা আছে। আবার তিনিই নাকি অবৈধ ইট ভাটা মালিক সমিতির বড়নেতা।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ ইট ভাটার মালিকরা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ উপজেলা প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার আছে। কিন্তু ব্যবস্থা এ প্রক্রিয়া অনেকটা মন্থর, এটাও রহস্যজনক। একটু লেখালেখি হলে নড়েচড়ে বসে। নইলে চলে স্বাভাবিকের মতো।

আইনের সঠিক প্রয়োগে পরিবেশ আইনে অভিযুক্ত হলে অতিমুনাফা লোভী জনপ্রতিনিধিদের পদে থাকার বৈধতাও থাকবে না। অপকর্ম রোধ ও পরিবেশরক্ষায় এমন শাস্তির উদাহরণ থাকলে ভবিষ্যতে কোনো জনপ্রতিনিধি এসব অপকর্মে জড়ানোর সাহস পাবে না।

ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এই অনাচারে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রকৃতির। এসবের প্রভাব ইতিমধ্যে লক্ষণীয়। জলবায়ু পরিবর্তনের মোড়কে প্রকৃতি তার আপন গতিতে ফিরিয়ে দিচ্ছে তার প্রতি বিরূপ আচরণের ফল। যার কুফল আমাদের বইতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজস্মান্তর।

লেখক: সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচলার পথে বিশ্বাসটাই মুখ্য
পরবর্তী নিবন্ধউম্মতের প্রতি নবীজীর ও নবীজীর প্রতি মুমিনদের ভালোবাসা