ইটভাটায় বিপন্ন চন্দনাইশের পরিবেশ

৩১টির মধ্যে ২৫টিই অবৈধ ।। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড় বন-জঙ্গল, পেয়ারা ও লেবু বাগান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ করার দাবি

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৫ মার্চ, ২০২৩ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

চন্দনাইশের পাহাড় ও সমতলে গড়ে উঠেছে ৩১টি ইটভাটা। এরমধ্যে বৈধ কেবল ৬টি, বাকি ২৫টিই অবৈধ। উপজেলার কাঞ্চননগর, পূর্ব এলাহাবাদ, হাশিমপুর, সাতবাড়িয়াসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটায় নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও। পাহাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা এসব ভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে পাহাড়ের মাটি, লাকড়ির জন্য জোগান দেয়া হচ্ছে পাহাড়ি গাছ। এতে সাবাড় হচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়। এদিকে পেয়ারা ও লেবুর জন্য দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করলেও ইট পোড়ানোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় চন্দনাইশের ঐতিহ্যবাহী কাঞ্চন পেয়ারা, লেবুসহ বিভিন্ন বাগান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইটভাটা সংশ্লিষ্ট এলাকায় আগের মতো হচ্ছে না ধান ও সবজি চাষ। মাটি ও ইট পরিবহনের সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট। গাড়ি চলাচলের সময় ধুলোবালিতে ক্ষেতখামার, বিভিন্ন গাছপালা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় জনসাধারণ সর্দি, কাঁশি, চর্ম ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অবৈধ ইটভাটাগুলো এক প্রকার বিষিয়ে তুলেছে পুরো চন্দনাইশের পরিবেশ।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ শাখা১ এর উপসচিব ড. ছৈয়দ শাহজাহান আহমেদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ইটভাটার দূষণমাত্রা, আশেপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ, ইটভাটায় জ্বালানি ব্যবহারের ধরন এবং অবস্থান বিবেচনা করে অধিক ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টিকারী ইটভাটাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ করার কথা বলা হলেও আদতে বন্ধ করা হয়নি এসব অবৈধ ইটভাটার একটিও।

স্থানীয় সূত্রে বলা হয়, প্রশাসনের নাকের ডগায় গড়ে তোলা এসব ইটভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড়ি মাটি, ইট পোড়ানোর জন্য নির্বিচারে কাটা হচ্ছে বনের গাছ। এতে ন্যাড়া হয়ে পড়েছে প্রায় প্রত্যেকটি পাহাড়। আশেপাশের ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে নেয়ায় জমি তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চাষাবাদ। ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাবে পেয়ারা, লেবু, আনারসসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ বাগান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে নেয়ায় অধিকাংশ জমিই এখন অনাবাদি পড়ে রয়েছে।

গত ৪ মার্চ বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের এক তথ্যানুসন্ধান টিম চন্দনাইশের কাঞ্চনাবাদে গড়ে ওঠা ইটভাটা সমূহ সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনে এসব অবৈধ ইটভাটার পরিবেশ বিধ্বংসী চলমান কর্মকাণ্ড চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদ পূর্বক পরিবেশ বাঁচানোর জন্যে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান সাংবাদিকদের বলেন, ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় এলাকার ঐতিহ্যবাহী কাঞ্চন পেয়ারার বাগান, লেবু বাগান ও কাঞ্চনধানের চাষ ধ্বংস হয়ে গেছে, ক্ষেত কামারে ফলন নেই, ধূলায় ধোঁয়ায় বিবর্ণ হয়ে গেছে ফুলে সুশোভিত আম্রপালি ও গাছের পাতা, জমির টপ সয়েল বলতে কিছু নেই। এলাকাবাসী ভুগছে চর্মরোগ আর শ্বাসকষ্টে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বা মোবাইল কোর্ট নির্লিপ্ত এসব এলাকায়। ভয়ে মুখ খুলতে পারে না এলাকাবাসী। তিনি জানান, পুরো চন্দনাইশে ৩১টি ইটভাটার মধ্যে ২৫টিই অবৈধ। শুধু কাঞ্চনাবাদেই আছে ১৭টি অবৈধ ইটভাটা। যেখানে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির মালিকানাধীন ইটভাটাও রয়েছে।

চন্দনাইশে ৩১টি বৈধ ও অবৈধ ইটভাটার তালিকা : মেসার্স আহমদ এন্ড ব্রাদার্স, মেসার্স কাশেম ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স শাহসূফি ব্রিঙ ম্যানু (এসবিএম), মেসার্স মরিয়ম ব্রিঙ ম্যানু (এমবিএম), মেসার্স বিসমিল্লাহ ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স আমিনুল হক এন্ড মোহাম্মদ আলী ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স ন্যাশনাল ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স জেএমসি ব্রিঙ (নবায়ণ), মেসার্স খাজা ব্রিঙ ম্যানু (ফাইভ বিএম), মেসার্স শাহ আমানত ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স এবিএম ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স থ্রি বিএম ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স শাহ জোহাদীয়া ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স রহমানিয়া ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স চৌধুরী ব্রিঙ ম্যানু (সিবিএম), মেসার্স কাঞ্চননগর ব্রিঙ ম্যানু, এম এইচ ওয়াই ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স ফোর বিএম ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স শাহ আমানত ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স রহিম ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স শাহ আলী রজা (.) ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স এ আর ব্রিঙ ম্যানু (এআরবি), মেসার্স নিউ আলী শাহ ব্রিঙ ম্যানু (এএইচএম), মেসার্স এ এইচ ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (.) ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স সাতবাড়িয়া ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স বিসমিল্লাহ ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স বারো আউলিয়া ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স খাজা ব্রিঙ ম্যানু, মেসার্স আলীশাহ ব্রিঙ (এবিএন), মেসার্স খাজা ব্রিঙ ম্যানু।

চন্দনাইশ ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম সাংবাদিকদের বলেন, এখানকার প্রায় সবগুলো ইটভাটাই ঝিকঝ্যাক (আইনসিদ্ধ চিমনি যুক্ত)। অনেক ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে। যেগুলোর ছাড়পত্র নেই সেগুলোর জন্য ইতিমধ্যে আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের এক বছরের জন্য ছাড়পত্র দেয়া হয়। পুনরায় ছাড়পত্র নবায়ন করতে গেলে শুরু হয় নানা টালবাহানা। ফলে সময়মতো ছাড়পত্র পাওয়া যায় না। এরমধ্যেই আমরা অবৈধ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান আজাদীকে বলেন, ব্রিক ফিল্ডগুলোর বিষয়ে প্রশাসন সবসময় সচেতন থাকে। নানা সময় অভিযান চালিয়ে গাইডলাইন অমান্যকারীদের জরিমানা ও কাগজপত্র বা লাইসেন্স বিহীন প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। চন্দনাইশের ব্রিক ফিল্ডগুলোতে কয়েকদিন আগেও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং জরিমানা করা হয়েছে। এমন অভিযান চলমান থাকবে। তিনি খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনে আবারো অভিযান চালানো হবে বলেও দৈনিক আজাদীকে জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইটভাটা মালিকসহ ১৩ ব্যক্তিকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা জরিমানা
পরবর্তী নিবন্ধকরদাতা সুরক্ষা পরিষদের নগর ভবন ঘেরাও কর্মসূচি আজ