আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অনেকগুলো জেলে পরিবারের স্বপ্ন। মাছ ধরার মৌসুম শুরু হলেও তাদের পক্ষে আর সাগরে জাল ফেলা সম্ভব হবে না। তাদের জালসহ মাছ ধরার সব সরঞ্জাম পুড়ে গেছে।
নগরীর ইপিজেড থানাধীন আউটার রিং রোডের বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী আকমল আলী রোডে শনিবার গভীর রাতের অগ্নিকাণ্ডে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্তরা দাবি করেছেন। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, মশার কয়েল থেকে আগুনের সূত্রপাত। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে।
স্থানীয় সূত্র ও ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, শনিবার রাত ১২টা নাগাদ আকমল আলী সড়কের জেলেপাড়ায় আগুন লাগে। খবর পেয়ে আগ্রাবাদ, বন্দর, ইপিজেড ও কেইপিজেড স্টেশনের ৯টি ইউনিট প্রায় সাত ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে গতকাল সকাল ৭টা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে গতকাল দুপুরেও স্থানটিতে থেমে থেমে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আগুনে সবগুলো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওখানে ২৪ জন বোট মালিকের ৩০টি জালঘর (জাল ও মাছ ধরার সরঞ্জাম রাখার ঘর), তিনটি তেলের দোকান, দুই ভাঙারি, পাঁচটি চায়ের দোকান, নৌকা মেরামতের ওয়ার্কশপ ও কয়েকটি বসতঘর মিলে মোট ৩৭টি ঘর ছিল। বেড়া ও টিনের এসব ঘরের অনেকগুলো গত বছর তৈরি করা হয়েছিল।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, একটি বদ্ধ ঘর থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় এবং মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। তেলের দোকান থাকায় আগুনের দ্রুত বিস্তার ঘটে। ওখানে জালঘর কিংবা দোকানের মালিকরা কেউ কাছে ঘেঁষতে পারেননি। উদ্ধার করতে পারেননি কোনো কিছু। রাস্তার দিকে যেতে না পেরে জেলে এবং দোকানিরা সাগরের দিক থেকে গিয়ে কিছু উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখায় কেউ কাছে যেতে পারেননি। সবাই সাগরে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বপ্ন পুড়ে যেতে দেখছিলেন আর হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।
সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর জেলেরা সাগরে জাল ফেলছিলেন। কিন্তু প্রত্যাশিত মাছ না পেয়ে অনেকে কয়েকদিন অপেক্ষা করছিলেন। কারণ সাগরে জাল নিয়ে গেলে খরচ; কিন্তু মাছ কম পেলে সেই খরচ উঠে আসে না। তাই মাছের মৌসুম পুরোপুরি আসার জন্য অপেক্ষায় থাকা জেলেরা কয়েক দিনের মধ্যে সাগরে নৌকা ভাসানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। জালঘরগুলোতে জালসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম গুছিয়ে রেখেছিলেন। শনিবার রাতের আগুনে ঘরগুলো থেকে কিছু বের করা সম্ভব হয়নি। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, একেকজন জেলের কাছে জাল এবং রশিসহ লাখ লাখ টাকার সরঞ্জাম ছিল। মহাজন এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে জেলেরা এসব সরঞ্জাম কিনেছিলেন। মাছ ধরে বিক্রি করে এসব দেনা লাভসহ শোধ করার কথা ছিল। এখন সাগরে যাওয়ার পথই বন্ধ হয়ে গেছে বলে গতকাল একাধিক জেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের জানান। তারা বলেন, আমাদের সম্বল বলতে আর কিছুই নেই, সবই পুড়ে গেছে। এখন নিজের জাল, নৌকা নিয়ে সাগরে যাওয়া তো দূরের কথা, হয়তো পরের নৌকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবন বাঁচাতে হবে।
মাহবুব আলম নামে এক জেলে জানান, জালঘরের পাশাপাশি আমি এই এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করি। আগুনে আমার সবকিছু পুড়ে গেছে।
তিনি জানান, দুটি কাঠের তৈরি বড় এবং পাঁচটি ছোটসহ সাতটি ফিশিং বোট রয়েছে তার। সেগুলোর মধ্যে বড় দুটি বোট সাগরে রয়েছে। মাছ কম থাকায় ছোট ট্রলারগুলো সাগরে নামেনি। বসতঘরের পাশে তার চারটি জালঘর ও একটি তেলের দোকান পুড়েছে। ছোট বোটগুলোর ইঞ্জিন খুলে জালঘরে রেখেছিলেন। একইসাথে ছিল বেশ কিছু জালসহ মাছ ধরার সরঞ্জাম। সব মিলিয়ে মাহবুবের অন্তত ১ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।
ইলিয়াস নামে আরেক জেলে জানান, তার প্রায় ৩৫ লাখ টাকার সম্পদ পুড়ে গেছে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ করে তিনি জাল, রশিসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়েছিলেন। রেখেছিলেন ৪০ ফুট বাই ৩০ ফুটের একটি জালঘরে। ঘরে ছোট–বড় বিভিন্ন ধরনের ২০০ জাল, তিন টন রশিসহ চারটি বোটের মালামাল ছিল। সব পুড়ে গেছে।
কিরণ নামে একজন জেলে জানান, ৩০ ফুট বাই ২০ ফুটের কাঁচা জালঘরে তার ছোট–বড় বিভিন্ন ধরনের ৪০টি জাল ছিল। এছাড়া মাছ ধরার সরঞ্জামসহ তার প্রায় ১১ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, জালঘরের কাছেও যেতে পারিনি। চোখের সামনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক। প্রাণহানি না হলেও অভাবী জেলেদের বেঁচে থাকার অবলম্বনই পুড়ে গেছে।
অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্য মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, আগুনে জাল রাখার ঘরগুলো পুরোপুরি পুড়ে গেছে। সেখানে সাগরে মাছ ধরার বেশ কিছু জালসহ নানা সরঞ্জাম ছিল বলে জেলেরা জানিয়েছেন। আমরা যখন ঘটনাস্থলে যাই, তখন জাল রাখার ঘরগুলোতে আগুন জ্বলছিল। কী পরিমাণ জাল ছিল বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত সেটা তদন্তসাপেক্ষে বলা যাবে।