ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম নীরবে চলে গেলেন। কেউ জানলো না, কেউ শুনলো না, কখন এ মহান মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গতি থেমে গেল। শেষ জীবনে মার্কিন মুলুকে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ, কিন্তু সেই স্বদেশে, মাতৃভূমিতে শেষ শয্যায় শায়িত হতে পারলেন না।
পটিয়া থানার জিরি গ্রামের মওলানা আমজাদ আলী খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ ইব্রাহিম লেখাপড়া শিখে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন। চাকরি নিয়েছিলেন চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী পেপার মিলে। সেখানেই যদি তাঁর ভাবী জীবন বাঁধা পড়তো, তাহলে আজকে ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিমকে নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন পড়তো না। ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম আমাদের কাছে ছিলেন ইব্রাহিম ভাই, কখনো বা ‘বদ্দা’। ’৭১ সালের মার্চ মাসে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ইব্রাহিম ভাই সে আন্দোলনে যোগ দিয়ে জনগণের কাতারে এসে দাঁড়ান। সেখানে তখন স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের প্রথম ডিসি সামাদ সাহেব এডিসি হিসেবে ছিলেন। রাঙামাটিতে ডিসি ছিলেন এইচ টি ইমাম। তাঁদের নেতৃত্বে ইব্রাহিম ভাই, ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক ভাই, ইসহাক বীর প্রতীক এবং আরো অনেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। আমার বন্ধু ন্যাভাল কমান্ডো শাহ আলম বীর উত্তমের পিতাও কাপ্তাইতে কর্মরত ছিলেন। শাহ আলম সেখানেই পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
অসহযোগ আন্দোলন থেকে নতুন ইব্রাহিম ভাই-এর জন্ম হয়, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম ভাই। ১নং সেক্টরে রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতা যাঁদেরকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত ও পরিচালনা করতে দেখেছি, তাঁরা হলেন হান্নান ভাই, মান্নান ভাই, ইউসুফ ভাই, ইব্রাহিম ভাই, হাশেম ভাই, ছাবের ভাই, স্বপনদা (শহীদ), জালাল ভাই (চট্টগ্রাম কলেজ)। আরো অনেকেই ছিলেন যেমন মিরসরাইর র্ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ ভাই, মন্টু দা (জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ মন্টু), ফটিকছড়ির মির্জা মনসুর ভাই, বাদশা আলম ভাই, আজিম ভাই, হাটহাজারীর ওহাব ভাই, জামাল ভাই, রাউজানের ডা. জাকেরিয়া চৌধুরী, নুরু মিয়া মাস্টার প্রভৃতি ছিলেন। হরিণা ও সাব্রুমে যাঁরা ছিলেন আমি তাঁদের কথা লিখলাম, কারো নাম বাদ পড়লে আমাকে ক্ষমা করবেন। আগরতলা উদয়পুরের দিকে জ্যেষ্ঠ নেতারা ছিলেন, যেমন জহুর আহমদ চৌধুরী, এমআর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল হারুন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ প্রমুখ।
হান্নান ভাইকে বাদ দিলে মান্নান ভাই থেকে জালাল ভাই পর্যন্ত প্রথমে আমি যাঁদের নাম লিখেছি, তাঁরা মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ-এর সঙ্গে যুক্ত হন। শুধু যুক্ত হওয়া নয়, চট্টগ্রাম বিএলএফ তাঁরাই সংগঠিত করেন। সমগ্র দেশকে চার ভাগে করে বিএলএফ-এর চার শীর্ষনেতা-শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের অধীনে ন্যস্ত করার হয়। পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ আমাদের এলাকা-চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ইত্যাদি এলাকার জন্য মণি ভাই দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মণি ভাইর আলোচনায় ইব্রাহিম ভাইয়ের নাম এসে পড়ে। মান্নান ভাই, ইউসুফ ভাই, ইব্রাহিম ভাই- এই তিনজন মণি ভাই’র খুব বিশ্বস্ত সহকারী হিসেবে পরিগণিত হন। মুজিব বাহিনীর অনেক সংগঠক ছিলেন। কিন্তু প্রধান সংগঠক ছিলেন উপর্যুক্ত তিনজনই। স্বপনদা ও ছাবের ভাইয়ের কথাও আমি মনে রেখেছি। তিনজনের মধ্যেও ইব্রাহিম ভাইকে গুরুত্ব দিতে হয় এ কারণে যে, তাঁর কোন রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো না। কিন্তু মান্নান ভাই ও ইউসুফ ভাইয়ের ছিলো। রাজনৈতিক যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও ইব্রাহিম ভাই যে সামরিক কর্মকাণ্ডে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, সে কারণে অন্যদের তুলনায় তাঁর কিছুটা বাড়তি প্রশংসা প্রাপ্য হয়। মণি ভাই’র যে কমান্ড স্ট্রাকচার ছিলো, তাতে ইব্রাহিম ভাই সদস্য ছিলেন। এত বড় মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ইব্রাহিম ভাই যে কোন সম্মান বা স্বীকৃতি পেলেন না, তা ভাবলে মনটা ব্যথায় মোচর দিয়ে ওঠে।
রাজনীতির মানুষ না হলেও যুদ্ধটা যেহেতু রাজনীতির কারণে হচ্ছিলো, ইব্রাহিম ভাইও রাজনীতিক হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীনতার পরেও মণি ভাই তাঁকে ছাড়েন নি। তিনি আওয়ামী যুবলীগ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইব্রাহীম ভাইকে সাত সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির সদস্য করেছিলেন। চট্টগ্রামেরও প্রথম আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। পরে যখন যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়, তখনও সম্ভবত ইব্রাহিম ভাইকে যুবলীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য রাখা হয়েছিলো।
অন্যদিকে বালাগামওয়ালা ভেজিটেবল অয়েল মিল নামে অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ইব্রাহিম ভাইকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেন মণি ভাই। পরে তাঁকে চিফ এঙিকিউটিভ করা হয়। বালাগামওয়ালাতে অনেক মুক্তিযোদ্ধার চাকরি হয়, ইব্রাহিম ভাইও কয়েকজনকে চাকরি দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোবারক ভাই কমার্শিয়াল ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার হারুন ভাই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, আফসার ভাই ও ছালাম ভাই একাউন্টস অফিসার এবং রফিক মাস্টার সেলস অফিসার পদে যোগদান করেন। ইব্রাহিম ভাইকে কেন্দ্র করে বালাগামওয়ালায় যেন চাঁদের হাট বসে গিয়েছিলো।
মোবারক ভাই ১৯৭৩ সালে বিসিএস পাস করে বালাগামওয়ালার চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পদায়ন করা হয়। টেঙটাইল কর্পোরেশনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর তিনি প্রশাসনে চলে আসেন । তিনি ঢাকার ডিসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদকালে মোবারক ভাই নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হন।
হারুন ভাইও বেশিদিন ছিলেন না বালাগামওয়ালায়। তিনিও চাকরি ছেড়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি নিয়ে চলে যান।
আফসার ভাই, রফিক মাস্টার ও ছালাম ভাই চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার বিভিন্ন মিলে বিভিন্ন পদমর্যাদায় চাকরি করে যথাক্রমে সংস্থার মহাব্যবস্থাপক (শিপিং) ও মহাব্যবস্থাপক (ফাইন্যান্স) হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
ইব্রাহীম ভাই সম্ভবত ৭৪ সালের দিকে বালাগামওয়ালা থেকে চলে আসেন এবং ঢাকা গিয়ে অন্য আরো দু’তিন জনের সঙ্গে মিলে একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সেটা সফল না হওয়ায় চট্টগ্রামে এসে মোহাম্মদ মিয়া নামে সীতাকুণ্ড এলাকার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ‘ইসলামাবাদ গার্মেন্টস’ নামে একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন। পাঠানটুলীর চৌমুহনীর সাধারণ বীমা ভবনে সেই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ছিলো। কিন্তু পার্টনারের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় ইব্রাহিম ভাই’র ঐ গার্মেন্টসটিও বন্ধ হয়ে যায়। হতাশায় ছেয়ে যায় ভালো মানুষটির অন্তর। ভাঙ্গা মন নিয়ে সস্ত্রীক দেশের মায়া কাটিয়ে মার্কিন মুলুকে চলে যান ইব্রাহিম ভাই।
তিনি যখন গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন, তখন এদেশে হাতেগোনা চার-পাঁচটি গার্মেন্টস ছিলো; তাঁকে সেজন্য গার্মেন্টস শিল্পের পথপ্রদর্শক হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে।
একটি ঘটনা মনে পড়ছে। একদিন আমার বন্ধু স্বপন চৌধুরীকে নিয়ে খাতুনগঞ্জে মোহাম্মদী ট্রেডিং ও বালাগামওয়ালার অফিসে (বর্তমানে টিকে ভবন) ইব্রাহিম ভাই’র সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তার একটা কারণ হলো তাঁর ছোট ভাই ফরিদ বাঙালি আমার বন্ধু ছিলো। যাই হোক, চা নাস্তা সহকারে খোশগল্পের পর ইব্রাহিম ভাই আমার দিকে একটি কাগজ ঠেলে দিয়ে বললেন, নাসির চলবে কিভাবে? এটা রাখো, কাজে লাগবে। আমি সবিনয়ে কাগজটা তাঁকে ফেরত দিয়ে বললাম, আমার এসব লাগবে না। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কি করছো নাসির, বুঝতে পারছো না তোমাকে কত বড় সুযোগ দিলাম। বালাগামওয়ালার পারমিট, ডিলারশিপের জন্য মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছে আর তুমি হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছো। আমার বন্ধু স্বপনও খুব অবাক হয়ে গেলো। পরে সেখানে থেকে যখন বেরিয়ে আসলাম, স্বপন আমাকে বললেন, কি করলেন নাসির ভাই। আপনার মতো বেকুব মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
ইব্রাহিম ভাই চট্টগ্রাম শহরের একটি বিখ্যাত প্রাচীন অভিজাত বংশের একজন বিদূষী নারীকে জীবন সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর শ্বশুর আকরাম খান স্বনামখ্যাত সমাজসেবী এবং দাদা শ্বশুর আমানত খান বিএল প্রখ্যাত স্বদেশ প্রেমিক এবং বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ছিলেন।
গত বছরের ৩১ মার্চ ইব্রাহিম ভাই স্ত্রী ও এক কন্যাকে রেখে নিউইয়র্কে পরলোকগমন করেন। ইব্রাহিম ভাইর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তিনি একজন পরোপকারী, সদালাপী, বন্ধুবৎসল, সৎ ও মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন কৃতী সন্তান হারালো। প্রকৃতই তিনি একজন উঁচু মাপের মানুষ এবং মহান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জয়তু ইব্রাহিম ভাই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক