ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের দূরদৃষ্টির ফসল আজাদী

৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকীর সেমিনারে তথ্যমন্ত্রী

আজাদী প্রতিবেদন  | শনিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, দৈনিক আজাদী স্বাধীনতার পূর্বে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে ধারণ করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ও পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সেজন্য দৈনিক আজাদী নিশ্চয়ই সমাজে এবং রাষ্ট্রে ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার রাখে। এজন্য দৈনিক আজাদী পরিবারকে আমিও ধন্যবাদ জানাই।

গতকাল শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত ‘মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, দৈনিক আজাদী এবং গণতন্ত্র’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতি এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, উদ্বোধক ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। বক্তব্য দেন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ, রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল, স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতির উপদেষ্টা লায়ন এম এ সামাদ খান, সেমিনার উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী, দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক, হাফেজ আমান উল্লাহ, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ। সভাপতিত্ব ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতির সভাপতি এস এম জামাল উদ্দিন। সঞ্চালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন বলেই ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেন মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ আরো বলেন, আজাদী শুধুমাত্র পত্রিকা নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। একটি পত্রিকা বা একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সহজ কাজ নয়। এটা অনেক কঠিন কাজ। আজাদীর আগেও নানা সময়ে চট্টগ্রামে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো টিকে থাকেনি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যখন অন্য পত্রিকা ছাপেনি তখন দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হয়েছে। সেজন্য দৈনিক আজাদী পরিবার গর্ব করে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের ৫৮ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কৃতজ্ঞতা জানাই এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য।

তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন। আরামআয়েশ করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সরকার চাকরি করেন তারা কিন্তু চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে চান না। কিন্তুৃ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক করেছেন।

তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, অত্যন্ত গৌরব ও সফলতার সাথে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দৈনিক আজাদী চালু আছে। বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলোর একটি আজাদী। ঢাকার অনেক পত্রিকার চেয়েও আজাদীর সার্কুলেশন বেশি। এই কৃতিত্ব প্রথমত ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের এবং পরবর্তীতে যারা এই পত্রিকার হাল ধরেছেন, মরহুম অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও এম এ মালেক, তারাও কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই পত্রিকাকে অত্যন্ত সফলতার সাথে পরিচালনা করে আসছেন। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার ৬০ বছরেও দৈনিক আজাদী নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ১০০ বছর, ২০০ বছর পরও দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হবে সেই প্রত্যাশা করছি।

চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, আজাদী এবং চট্টগ্রাম এক ও অভিন্ন। আজাদীকে বাদ দিলে চট্টগ্রাম হবে না এবং চট্টগ্রামকে বাদ দিলে আজাদী হবে না। এভাবে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চট্টগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন। তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর প্রেসে গিয়ে কোন বেকার ছেলে কাজ ছাড়া ফেরত আসেনি।

সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইঞ্জিনিয়ার খালেক দৈনিক আজাদীর আগে কোহিনূর পত্রিকা প্রকাশ করেন, এর কপি এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। সৈয়দ আহমেদ ছিরকোটি, তৈয়্যব শাহ, তাহের শাহ হুজুর যে এখানে আসেন সেটার ধারাবাহিকতার সূত্র করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার খালেক। আজকে যে সুন্নিয়া মাদরাসা তার একজন ফাউন্ডার ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।

সাবেক এই মেয়র বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আজাদী পত্রিকার যে অবদান তা চট্টগ্রামবাসীকে তথা বাংলাদেশের আপামর জনগণকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেয়া এবং সাধারণ নাগরিককে মুক্তিযোদ্ধাকে সমর্থন করার জন্য লেখনী ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করে আজাদী। ১৯৭১ সালের মার্চে আজাদী তিনভাবে বের হয়। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো তুলে ধরার জন্য সকালে আজাদী পত্রিকা, বিকেলে টেলিগ্রাম এবং রাতে সন্ধ্যাকালীন পত্রিকা হিসেবে। তিনি বলেন, সে আমলে এত কমিউনিকেশন সিস্টেম ছিল না। বলতে গেলে একটাই পত্রিকা তথা আজাদীর উপর নির্ভর করতে হতো। যদি ঢাকা থেকে বের হতো তাহলে আজাদীকে ন্যাশনাল লেবেলে অন্যভাবে মূল্যায়ন করা হতো। তিনি বলেন, সংবাদ জগৎ মানে আজাদী, আজাদী মানে চট্টগ্রাম। আমাদের এভাবেই মূল্যায়ন করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ বলেন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকট ছিল বলেই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর মত লোভনীয় পদ ছেড়ে দিয়ে পত্রিকা প্রকাশের ঝুঁকি নিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তিনি বলেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যত উত্থানপতনের ঘটনা আমরা আজাদীর মাধ্যমে জানতে পারতাম। যখন অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া কার্যকর ছিল না সে অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ার খালেক বুঝতে পেরেছিলেন, জাতিকে যদি জাগাতে হয় সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। এটা ছিল তাঁর দূরদর্শিতা। যেটা সবার থাকে না।

দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন আমার বাবা। আবার অত্যন্ত ধার্মিকও ছিলেন তিনি। আজান দিলেই সবকিছু ছেড়ে জামায়াতে নামাজ পড়তেন। ১৯৬০ সালে দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর, সেদিন ছিল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। নবী প্রেমের কারণেই দিনটি বেছে নেন বাবা।

তিনি বলেন, যখন দৈনিক আজাদী বের হয় তখন অর্গানাইজ কোন হকার ছিল না। তিনি (ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক) সকালে মসজিদ থেকে আসার সময় হকারদের ধরে নিয়ে আসতেন। তাদের পত্রিকা দিতেন এবং পয়সা নিতেন না। তখন কাগজের দাম ছিল দুই আনা। একজনকে ১০টা কাগজ করে পাঁচদিন দিতেন। পাঁচদিন পর হকারদের বলতেন, যে টাকা জমেছে সেটা আমার, তবে তোমাদের কাছ রাখ। এবার টাকা দিয়ে আমার কাছ থেকে কাগজ কিনে নিয়ে যাও। এর মধ্য দিয়ে তিনি হকারদের ক্যাপিটেল দেন, কোন ঋণ দেননি। আজাদী সম্পাদক বলেন, স্বাধীন দেশে প্রথম সংবাদপত্র আমরা বের করেছিলাম। সংবাপত্রের ইতিহাস লেখা হলে আজাদীর নাম বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে লিখতে হবে।

রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের জন্ম রাউজানে। রাউজানবাসী হিসেবে তাই আমি গর্বিত। তিনি বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদীর অনন্য ভূমিকা ছিল।

দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক বলেন, আমি আমার দাদাকে (ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক) দেখিনি। যে উদ্দেশে দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য নিয়ে যেন আজাদী প্রকাশ করতে পারি সেজন্য সকলে দোয়া করবেন।

চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ বলেন, ঢাকার অনেক পত্রিকার চেয়েও সার্কুলেশন বেশি আজাদীর। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, চট্টগ্রামের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে আজাদী।

মূল প্রবন্ধে এস এম জামাল উদ্দিন বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছেন। চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্প, মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগতে তাঁর অবদান ঐতিহাসিক। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, সর্বোপরি ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দৈনিক আজাদী প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, যা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। গণতন্ত্রের পথকে সুগম করতে স্বাধীনভাবে লেখনী চালিয়েছে দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজার পুলিশের কর্মকর্তা থেকে কনস্টেবল সবাইকে বদলি
পরবর্তী নিবন্ধভ্যাকসিন নিয়ে ধনী দেশগুলোর কাড়াকাড়ি