দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ছিলেন প্রগতিশীল চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক ব্যক্তিত্ব। যাঁর মধ্যে ছিল দূরদর্শী বিচক্ষণতা। তিনি এ অঞ্চলে আলোকিত মানুষ সৃষ্টির জন্য ছাপাখানা, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন। একই সাথে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন সমাজের আলোকবর্তিকা। অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা, রাজনীতিসহ নানাক্ষেত্রে তিনি সফলভাবে বিচরণ করেছেন। তাঁদের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ–এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব তাঁদের জীবদ্দশায় মানবমুক্তি এবং সমাজকে আলোকিত করার যে পথ দেখিয়েছেন তা ধারণ করতে পারলে আগামী প্রজন্মও আলোকিত প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল ৫ জুলাই শুক্রবার চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে দিনব্যাপী শিশুমেলার আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এসব কথা বলেন।
সকালে শিশু সমাবেশ, আবৃত্তি ও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক। বিকেল ৫টায় আলোচনা, পুরস্কার বিতরণ, শিশুসাহিত্যিক মিলনমেলা, ছড়া–কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের। দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন ড. আনোয়ারা আলম, সাবেক অধ্যক্ষ রীতা দত্ত, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সন্তান স্লোগান সম্পাদক মোহাম্মদ জহির, মোহাম্মদ মনির, মোহাম্মদ জোবায়ের প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিশু সাহিত্যিক সাংবাদিক রাশেদ রউফ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী আয়েশা হক শিমু।
প্রধান অতিথি চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্মদিবসকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। কেননা তিনি জানতেন শিশুরাই আগামীর কর্ণধার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট সিটিজেন। আর স্মার্ট সিটিজেন হওয়ার জন্য আজকের শিশু কিশোরদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। যার কারণে বাবার কাছ থেকে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ প্রসঙ্গে প্রধান অতিথি বলেন, তিনি আজীবন সৎ সাংবাদিকতা করে গেছেন। আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অনুষ্ঠানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তাঁর কাছে জেনেছি। ইতিহাসের অংশ হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমাদের কাছে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। একই সাথে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস ও দৈনিক আজাদীর অবদানও ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। উপাচার্য বলেন, শিশুদেরকে পারিবারিক সংস্কৃতিতে আরো বেশি মননশীলভাবে গড়ে তুলতে হবে। পিতা মাতার শিক্ষা একজন শিশুর ভবিষ্যত গড়ে ওঠার পথে সহায়ক। বঙ্গবন্ধুর অসামাপ্ত জীবনীতে আমরা খুঁজে পাই, খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে গিয়ে তার পিতামাতা থেকে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের অভিভাবকদের জিপিএ ৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিশুরা যে বিষয়ে পড়তে আগ্রহী সে বিষয়ে পড়ার জন্য অভিভাবকদের গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের সন্তানদের যে হারে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা দিচ্ছি তা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা ও সামগ্রিক জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এর থেকে আমাদের বের হওয়ার পথ খুঁজতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুদের অন্তরে। আমার বাবা আমার আইডল। বাবার কর্মময় জীবনে মানব মুক্তির চিন্তা ও চেষ্টাই মূখ্য ছিল। তিনি ভারতের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হতে পাশ করে বেছে নিয়েছিলেন পত্রিকা প্রকাশের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব। তিনি ভিক্ষুকের হাতকে শ্রমিকের হাতে পরিণত করেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সৎ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তাঁরা তাঁদের কর্মের মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন, সমাজ যেমন আমাকে দিচ্ছে, সমাজকে কিছু দেয়া আমারও দায়িত্ব। তিনি বলেন, একুশ আমাকে শিখিয়েছে মাথা নত না করার। সে সাহসটা আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী একটা কবিতা লিখেছিলেন, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। সেই কবিতাটা কিন্তু আমার বাবা আমাদের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছেপে দিয়েছিলেন। বাবা কিন্তু জানতেন এ কবিতা ওই সময়ে ছাপানো মানে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু মাতৃভাষা নিয়ে বাবা কোনো সমঝোতা করেননি, মাথা নত করেননি।
একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেক বলেন, মা–বাবা–শিক্ষক এ তিন বন্ধু জীবনে শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তারা কখনো কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করেই সাহায্য করে যান। পদক পাওয়ার আশা নিয়ে কোনো কাজ করলে পদক আপনি পাবেন না। কাজ করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। কারণ পরবর্তীতে সেটার বিচার এবং পর্যালোচনায় অবশ্য মূল্যায়িত হবে। পুরস্কারের আশা করলে বরং পুরস্কার পেতে আরো দেরি হবে। আপনি যদি নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন তাহলে দেশ আপনাকে মূল্যায়ন করবে। তিনি বলেন, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমেছেন সেটা বাস্তবে রূপ দিতে হলে লেগে থাকতে হবে।
মেলার উদ্বোধক ওয়াহিদ মালেক বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমার যেমন রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়, তেমনি আদর্শের দিক থেকেও তাঁরা আমার পরম আত্মীয়। এই দুই মনীষীর জীবন আমার জীবন জুড়ে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এখনও আমি আমার যেকোনো কঠিনতম বিষয়গুলো সমাধানে এই দুই মনীষীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করি। তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ দেশপ্রেম, মহানুভবতা, কল্যাণকামী ও আদর্শ জীবন চর্চা করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তারা তাদের সমগ্র জীবনকে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। যা তাদেরকে অমরত্ব দান করেছে। তিনি বলেন, শিশু কিশোরদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি মনীষীদের জীবনী পাঠ, বাস্তবিক জীবনের শিক্ষাসহ দেশীয় সাহিত্য–সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করাতে হবে।
অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম বলেন, কোহিনূর পত্রিকার মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক অনেক মহিয়সী নারীদের মূল্যায়ন করেছেন। তিনি শবনম খান শিরওয়ানীকে সহযোগী সম্পাদক করে নারীদের মূল্যায়ন করেছেন। আমি সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার সকল সংখ্যা পড়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটা দর্পন রেখে গেছেন।
প্রফেসর রীতা দত্ত বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ দুজনই বরেণ্য মনীষী হিসেবে আমাদেরকে আলোর পথ দেখিয়ে চলেছেন। এই দুই মনীষী শিশুবন্ধুদের কাছেও অনেক অনুস্মরণীয় তাদের সাদা মন ও দেশপ্রেমের কারণে। তিনি শিশুদের সুস্থ বিকাশে এই দুই মনীষীর জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণের আহ্বান জানান।
সভা শেষে চিত্রাংকন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন অতিথিবৃন্দ। শেষে স্বরচিত কবিতা ও ছড়া পাঠে অংশ নেন প্রায় ৪০ জন কবি ও ছড়াকার।