চট্টগ্রামের রাংগুনিয়া উপজেলায় তেমনি কর্ণফুলী নদীর পাশাপাশি অনেক খাল রয়েছে। তন্মধ্যে ইছামতী খাল এ উপজেলায় একটি খুব পরিচিত প্রাচীন খাল। এই খালটি রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। খালটির জলধারা চট্টগ্রাম জেলার রাংগুনিয়া উপজেলার পৌরসভা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে নিপতিত হয়েছে। রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর, পারুয়া, লালাগনগর, হোসনাবাদ, স্বনির্ভর রাংগুনিয়া ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহকালে বেশ কয়েকটি ছোট খাল ও ছড়া মিলিত হয়েছে।
গত ত্রিশ বছর আগেও এই খাল ছিল অনেক ছোট আকারের। কিন্তু এই খালটি এক সময় উভয় পাশে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে আজ বিশাল আকারের খালে পরিণত হয়েছে। মনে হয় বিগত ত্রিশ বছর পূর্বের কর্ণফুলী নদীর আকারই ধারণ করেছে এই ইছামতী খাল। এক সময় উপকূলীয় মানুষের কাপড় কাচা, স্নান করা, নারীরা কোমড়ে কলসি নিয়ে রান্নার ব্যবহারে পানি আনাসহ চাষ–বাস, ক্ষেতখোলা ইত্যাদি কাজে এই ইছামতী খালের পানির ওপরই নির্ভর করতে হত। যদিও চাষ–বাস ছাড়া আজ আর আগের মতো নির্ভর করতে হয় না। এক সময় এই খালের পানির অভাবে চাষ করাও কঠিন হয়ে যেত। সে সমস্যাও আজ আর নেই। কেননা মোগলের হাটের পশ্চিম পাশে সৈয়দ নগর এলাকায় এই ইছামতী খালের ওপর নির্মিত হয়েছে রাবারড্যাম। ফলে খালে মৌসুমি পানির আর অভাব হয় না। তাতে করে এই খালের উপকূলে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেতখোলা হচ্ছে রাবারড্যামের সুফলে। এতে করে কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমাদের সময়ের সেই ইছামতী খাল এক সময় ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। যা গত ৯০–র দশকের পর থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে প্রায় প্রতি বছরই ভাঙ্গনের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতে করে অনেক বাড়ি–ঘর খালের পানিতে ভেঙে গিয়ে বিলীন হয়ে যায়। রাজার হাট টু মোগলের হাট সড়ক প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু এলাকায় ভিটে বাড়ির অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে পড়ে। দেখা যায়, কারো কারো ভিটে বাড়ি কয়েক একর জমির ওপর ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই একর সম ভূমিগুলি ইছামতী গ্রাস করে কয়েক শতকে নিয়ে আসে। মোগলের হাট টু রাজার হাট সড়কে কালাগাজির তালুক এলাকার বাসিন্দা এক সময়ের রাংগুনিয়ার খুব পরিচিত মুখ মরহুম সফি তালুকদারের বেশ কয়েক একর তার চাষের জমির সম্মুখে ইছামতীর অবস্থান ছিল। কিন্তু এর সম্মুখে আশেপাশে ইছামতী এখন নেই। ইছামতী বাঁক নিয়েছে। ইছামতীর পথ পরিবর্তন হয়ে পারুয়া ইউনিয়নের মহল্লেইর খলঘরে পৌঁছে গেছে ইছামতীর চলার পথ। ফলে এই এলাকায় কোথাও সিকস্তি হয়েছে অনেক একর ব্যক্তি মালিকানা জমি। আবার কোথাও গড়ে ওঠেছে অনেক অনেক একর পয়স্তি। এইভাবে মা ইছামতীর পরিবর্তন হয়েছে অনেক স্থানে। ইছামতীকে আজ আর খাল বলতে ইচ্ছে করে না। নদীই মনে হয়।
অবশ্য পৌরসভার রোয়াজারহাট এলাকা পর্যন্ত কর্ণফুলীর জোয়ার ভাটার সাথে ইছামতীও অংশ নিয়েছে।
ইছামতীর ভাঙ্গন রোধে কারো দাবি দাওয়াবিহীন সরকার উদ্যোগ নিয়েছে ইতিমধ্যে। স্থানীয় সাংসদ বর্তমান সরকারের মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী একান্তই তার নিজ উদ্যোগে সরকারিভাবে ইছামতীর উন্নয়ন ও ভাঙ্গন রোধে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। যেমন, ইছামতী খালের উভয় পাশে ব্লক বসিয়ে ইছামতীকে নিরাপদ করেছেন। বিভিন্ন স্থানে ইছামতীর হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে শত কোটি টাকার সড়ক নির্মাণ করেছেন। রাবারড্যাম স্থাপন করে ইছামতীর পানির সংকট দূরীভুত করেছেন। এতে করে চাষাবাদের ব্যাপক সুযোগ কৃষকেরা ভোগ করছেন।
ইছামতি অঞ্চলের ঘাগড়া খিল মোগল এলাকার বাদামতলির এক প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন হাজি সিদ্দিক আহমদ। তার একমাত্র পুত্র সন্তান মোহাম্মদ হোসেন। প্রায় এক একর জমির ওপর ছিল তাদের বাড়িভিটে। এখন তা নেই। তাদের বাড়ি–ভিটে যে কোনো মুহূর্তে ইছামতী গ্রাস করতে পারে। যেভাবে দুদু মিয়া জমাদারের ক্ষেতের জমিটা নিয়ে গেছে ইছামতী। যেভাবে নিয়ে গেছে লেদু সওদাগরের বাড়ির সামনে কালাবুড়ি, বাদশা, সিদ্দিক সওদাগরসহ আরো কয়েকটি পরিবারের ভিটেবাড়ি। এখানে তারা আজ অস্তিত্বহীন। ইছামতী তাদের সব নিয়ে গেছে। হাজি সিদ্দিক আহমদ এর সোজা ওপারে সন্তোষ দিপালীদের বাড়িরও একই অবস্থা। ইছামতীর অনেক জায়গায় বাঁক নিয়েছে। দক্ষিণ রাজানগর ফুলবাগিছা এলাকায় এবং খালের ওপারে হারুন কোম্পানির বাড়ির সম্মুখে ইছামতী সম্পূর্ণ কাপড় পাল্টে ফেলেছে। যদি না এখানে ব্লক বসানো হত তবে প্রধান সড়কটি বিলীন হয়ে যেত। যেমন বিলীন হয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে রাজ বাড়ির মুইচ্চা রাজার হাটের চামার পাড়া। আমাদের পার্শ্ববর্তী এবং উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি মান্নান তালুকদারের বাড়ি ও পাশের দাশ পাড়াকে মা ইছামতী ছোবল থেকে বিরত থেকেছে ব্লক বসানোর কারণে। এভাবে তেলি পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, সৈয়দ নগর, রাজার হাট এরিয়সহ ইত্যাদি পাড়া ইছামতীর কবল থেকে রক্ষা পেলেও অনেক পাড়ায়, স্থানে ইছামতী ফনা তুলে আছে।
নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এইতো নদীর খেলা। তেমনি খালেরও একই অবন্থা। ইছামতীও এর ব্যতিক্রম নয়। যেহেতু ইছামতীর ভাঙন রোধে ইছামতীর ভাঙন কবলিত বিভিন্ন অংশে ব্লক বসানো হয়েছে। সেহেতু ইছামতীর এ সব অংশে ভাঙার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যে সব কূলে, স্থানে ব্লক বসানো হয়নি সে সমস্ত এলাকায় ভাঙার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ ভাঙা শুরু হলে তা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যাবে। বর্তমানে সম্ভাব্য এ ধ্বংস লীলার প্রধান কারণ হচ্ছে বালি উত্তোলন। ইছামতীর বালি শুধুমাত্র রাংগুনিয়া উপজেলায় নয়, গোটা চট্টগ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট বালির ঠিকাদার। ফলে খালের নাব্যতা বৃদ্ধি হচ্ছে। আবার এ নাব্যতা বেশি দিন স্থায়ী হচ্ছে না। কারণ ইছামতীর যে সব অংশে ব্লক দেয়া হয়নি, সে সমস্ত কূল ভেঙে নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে খালের ড্রেসিংয়ের নামে সরকার পুনরায় বালির ইজারা দিয়েছে। এই ইজারাই ইছামতীর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে। বলো কোথায় তোমার দেশ তোমার নেই কি চলার শেষ, ও নদীরে। তোমার কোনো বাঁধন নাই তুমি ঘর ছাড়া কি তাই, এই আছো ভাটায় আবার এই তো দেখি জোয়ারে। ও নদীরে…। কারো দাড়ি, কারো স্ত্রীর যেমন বিশ্বাস নেই, তেমনি নদীর, খালের বিশ্বাস নেই। কখন কোন দিকে ছুটে। তবু রক্ষার জন্যে চেষ্টা করলে ক্ষতি কী।
সুপারিশ: প্রথম ভাগ– ১. ইছামতীর ভাঙন রোধে এবং খালের কূলবাসির স্বার্থে চলতি বছরের ইছামতী খালে বালির মহালের ইজারা বাতিল করা। যেহেতু ইতিপূর্বে বেশ কয়েক বছর একনাগাড়ে বালির ইজারা দেয়া হয়েছে। তাতে করে কোথাও কোথাও খালের নাব্যতা বেশ গভীরে চলে গেছে। লোকের মুখের ভাষায়, বালি খেকোরা ইছামতী খাল খেয়ে ফেলেছে। ২. পরবর্তীতে প্রতি পাঁচ বছর পর পর বালির ইজারা প্রদানে আইনী ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। তাতে করে খালে বালি জমাট হলে বা বালিতে খাল ভরে গেলে ইজারার মাধ্যমে খাল ড্রেসিং করা হবে এবং বালি থেকে বিভিন্ন প্রকারের ফায়দা নেয়া যাবে।
দ্বিতীয় ভাগ– ১. প্রতি পাঁচ বছর পর পর বালির ইজারা প্রদানের সাথে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা– (ক) বালির মেশিনের বল ব্লক থেকে দূরে বসানোর বিধান করা। যাতে করে বালি ব্লকের সামনে থেকে সরে গিয়ে ব্লকের সমস্যা না হয়। (খ) যে সমস্ত এলাকায় ব্লক বসানো হয়নি সে সমস্ত এলাকায় খুব বেশি সচেতনতা অবলম্বন করা। যেমন কোনো প্রকারেই খালের মাঝখানে ব্যতিত কূলের পাশে মেশিনের বল না বসানো হয়। ২. আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাতে করে ইছামতীর ভাঙন রোধে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী।