‘জীবন থেকে নেয়া’র স্রষ্টা জহির রায়হান জ্বলে পুড়ে মরছেন ইচ্ছের আগুনে। তাঁর খুব ইচ্ছে করে কুষ্ঠরোগীদের নিয়ে একটা ছায়াছবি বানাতে, শরীর থেকে মাংস গলে গলে পড়ার পরও যারা বলে যায়- কিচ্ছু হয়নি, এই বেশ ভাল আছি। সেই বন্ধুকে নিয়েও ছবি বানাতে সাধ হয় তাঁর, যে একুশের প্রথম প্রহরে মিছিলে যাবার আগে কানে কানে বলেছিল- যদি মরে যাই মাকে বোল না কাঁদতে- ‘তাকে বোল সময়ের ডাকে আমি মরলাম’। সেই বন্ধুটি কিন্তু মরেনি সেদিন। আজকাল যুবতী মেয়েদের ভেট পাঠায় আমলাদের দপ্তরে। এতদিনে ব্যবসাপাতি করে বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে। সেই তরুণদের নিয়ে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে মন চায় জহির রায়হানের, যাদের জীবন শত সহস্র দেয়ালের চাপে পিষ্ট হয়ে যায়। আইনের দেয়াল, সমাজের দেয়াল, ধর্মের দেয়াল, রাজনীতির দেয়াল, দারিদ্রের দেয়ালই কেবল নয় ঈর্ষা, ঘৃণা, মিথ্যা ও সঙ্কীর্ণতার দেয়ালে আটকে পড়ে শ্বাস নিতে পারেনা ওরা। মুক্তির জন্য ছটফট করে যায় ওরা ক্রমাগত। মুক্তি আসেনা, জীবন ফুরিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ভাবেন তিনি সমাজের অসংস্কৃত মানুষগুলো নিয়ে একটা ছবি বানাবেন যারা দিনরাত সংস্কৃতির বুলি আওড়ায়। তারা “কালচারের কথা বলে। ভাষার কথা বলে। ঐতিহ্যের কথা বলে। বলে আর বলে। কারণে বলে, অকারণে বলে”।
মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের পরমায়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা এই সৃজনশীল মানুষটি চলচ্চিত্র ও সাহিত্য জগতে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েই মিলিয়ে যান মহাবিশ্বে। তবে পরাধীন বঙ্গভূমি থেকে নয়, তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ হতে। ছোটবেলায় জানতাম অগ্রজ শহিদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি তিনি; বড়বেলায় এসে জানলাম তাঁকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে, দিনের আলোয়। আরেক ফাল্গুন দেখা হলনা তাঁর, মুক্ত বাংলায় প্রভাত ফেরিতে যোগ দেওয়াও হল না।
এই ক্ষণজন্মা তরুণ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মেতেছিলেন সৃষ্টিশীলতায়। তবু তাঁর মনে হত কোন কাজ হয়নি। আরও অনেক কাজ করার কথা ছিল। উনিশশো একাত্তর সালে ফেব্রুয়ারি মাস এলে শহীদ দিবস পালনের ঘনঘটা দেখে মন ভেঙে যায় তাঁর। বাংলা একাডেমির পুরস্কারের লোভে ম্যাগাজিন বের করার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করছে যুবকেরা। জমকালো ‘ফাংশান’ এ খ্যাতিমান শিল্পীর সমাবেশ ঘটানো নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা লেগে যায় নানা সংগঠনের মধ্যে। ‘কয়েকটি সংলাপ’ শিরোনামে মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠার এক নিবন্ধে জহির রায়হান বসিয়ে দেন ছোট ছোট কিছু সংলাপ। সামান্য দৃশ্যপটে অংকন করেন অসামান্য কিছু স্থিরচিত্র যা ছায়াছবির মতোই চলমান। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে রচিত সেই সংলাপ ও দৃশ্যপট এতটুকু বদালায়নি স্বাধীনতার প্রাপ্তির অর্ধশতক পরও। একুশ শতকের একুশতম একুশের প্রহরে অখ্যাত নির্বিবাদী লেখকেরও বুক ভেঙে যায় শোক দিবসের পোশাকী আয়োজনের উন্মাদনা দেখে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বলবত আছে সান্ধ্য আইন। বেরসিক প্রাদ্ধক্ষের চোখরাঙানোর ভয়ে ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যায় না। বিশ আর একুশ ফেব্রুয়ারী ওদের জন্য নিয়ে আসে স্বাধীনতা দিবস। রজনী বললেই যথার্থ হয়। শহীদ মিনারে আলপনা আঁকার নামে পুরো রাত বাইরে কাটালেও কারও কিছু বলার নেই। প্রভোস্টের ঘাড়ে ক’টা মাথা যে একুশের প্রহরে ওদের বাধা দেয়!
এক বড় আপিসের বড়কর্তার কাছে ছাত্র আসছে দলে দলে। একুশের সংকলন বের করছে ওরা। বিজ্ঞাপন চায়। বড়কর্তা তৎক্ষণাৎ অনুমোদন দিয়ে দেন খসখস করে। কোম্পানির ‘গুডউইল’ বলে কথা। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে একটা চার লাইনের কবিতা না হলে চলেনা। সে ব্যবস্থাও হয়ে যায়। কবিতা লেখা! কী এমন কাজ! তাঁর সহকারী নিজেই কয়েক পঙতি লিখে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন বড়সাহেবকে। সহকারীর কথা শেষ হয়না। মাস তিনেক আগে (সত্তরের নভেম্বর) ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি হারানো পিয়নটি একমাসের বেতন আগাম চেয়ে মিনতি জানিয়েছিল বড়সাহেব বরাবরে। একুশের সংকলন বের করার মতো জরুরী মুহূর্তে এইসব ছোটকাজে মন দেবার মতো সময় তাঁর হয়না। পত্রপাঠ সেই মিনতি বাতিল করে দেওয়া হয়।
সংস্কৃতি সংস্কৃতি করে ‘জান’ দিয়ে ফেলা যুবকের দল একুশের মৌসুমে রাজপথে কোন গাড়ির সংখ্যাফলক/ নম্বরপ্লেট ইংরেজিতে লেখা দেখলে মহা উৎসাহে গাড়ি ভাঙচুরে লেগে যায়। পাড়ার এক ধনবান পরিবারের মেয়েকে চিঠি পাঠিয়ে তার বাবার হাতে চড় খাওয়ার শোধ নেওয়ার মোক্ষম সময়ও আসে একুশে ফেব্রুয়ারিতে, কারণ সেই মেয়ের বাবার গাড়িতেও আছে ইংরেজি নম্বরফলক। কাজ শেষে গর্বিত যুবকেরা হিসেবে বসে কে কতগুলো কাঁচ ভাঙল, কতগুলো গাড়িকে বিকল করে দিল। বাহবা দিয়ে যায় তারা একে অন্যকে। বাংলা ভাষার মান রাখতে তাদের এই অবদানের কথা জাতি নিঃসন্দেহে চিরদিন স্মরণ রাখবে! কে জানে ওরাই হয়তো অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দেশটাকে দেখে রাখবে।
শেষ দৃশ্যপটে আছে আগামী দিনের কথা; একালের কথা, আমাদের কথা। জহির রায়হান যেন দিব্যচোখে দেখছিলেন আগামী দিনে বাংলার পথে-প্রান্তরে উচ্চারিত হবে এই কথাগুলো। তাঁর কলম থেকে সংলাপগুলো হুবহু তুলে ধরা যাক, তর্জমা বা পর্যালোচনা করার ভাষা জানা নেই বলেই-
“বছরে কতদিন?
তিনশ পঁয়ষট্টি দিন।
তিনশ পঁয়ষট্টি দিনে কয়টা শহীদ দিবস?
দুশো বিরানব্বইটা।
বাকী থাকে কয়টা?
তিয়াত্তরটা।
তিয়াত্তরটা আর বাকী রেখে কী হবে?
ওগুলোও ভরে ফেল।
আগুন জ্বালো।
পুরো দেশটায় আগুন জ্বালিয়ে দাও।
সাতকোটি লোক আছে।
তার মধ্যে না হয় তিন কোটি মারা যাবে।
বাকী চার কোটি সুখে থাকুক। শান্তিতে থাকুক।
পুরো বছরটাকে শহীদ দিবস পালন করুক ওরা।”
আঠারো কোটি প্রাণ বাঁচাতে তবে কি হাজার খানেক শহীদ দিবস চাই?