ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহীহ্‌ ইসলামী সংগঠনসমূহের ঘাটতি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২ জুন, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

আজ সমাজে ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠা নেই বলেই সমূহ দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, ছিনতাই, ইভটিজিং, জমি দখল ইত্যাদি অহরহ ঘটছে এবং ঘটতেই থাকবেযতদিন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা না হয়। মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়, আসমানের নিচে এবং জমিনের উপর একমাত্র সত্য কিতাব আল্‌কোরআনকে যতদিন ক্ষমতার মসনদে বসানো না যায়, ততদিন এই পৃথিবীতে পূর্ণাঙ্গ শান্তি স্থাপন সম্ভব হবে না। সমস্ত নবীরাসূলগণদের আল্লাহতায়ালা এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা কিংবা প্রতিনিধি হিসাবে, ‘যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা বানাতে চাই; তারা বলল, তুমি কি সেখানে এমন কাউকে খলিফা বানাতে চাও? তারা সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং এরা রক্তপাত করবে, আমরাই তো তোমার প্রশংসা সহকারে, তোমার তাসবিহ্‌ পড়ছি এবং তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি; তিনি বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’সূরা বাকারা৩০। অতএব বোঝা যায়, মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই নবীরাসূলগণসহ সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে এই দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। হযরত দাউদ (আঃ) কে আল্লাহতায়ালা খলিফা বানিয়েছেন মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার করার জন্য, ‘হে দাউদ, আমি তোমাকে জমিনে খলিফা বানালাম অতএব তুমি মানুষদের মাঝে ন্যায়বিচার কর এবং কখনো খেয়াল খুশির অনুসরণ কর না’সুরা সোয়াদ২৬।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘আমি মানুষ এবং জ্বীন জাতিকে আমার এবাদাত করা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি’সূরা আয যারিয়াত৫৬। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহর এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা গেল। আমরা কোন তাগুত শক্তিকে আল্লাহর এই জমিনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সৃষ্টি হইনিআল্লাহর বিরোধী শক্তিকে উপড়ে ফেলে কোরআনের রাজ কায়েম করাই হল একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু এই ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা মুসলিম সমাজ বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়েছি। আলেমেআলেমে বিভেদ, সাধারণ শিক্ষিত মহলের মাঝে বিভেদযেন মহামারী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মত বিরোধ, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, মিডিয়ায় অপপ্রচার, বিদ্বেষ ছড়ানো ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই কথাটি ১৪০০ বছর আগেই আল্লাহর কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবেই, ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দলেউপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে; এরাই হচ্ছে সেই সব মানুষ তাদের জন্যে কঠোর শাস্তি রয়েছে’সূরা ইমরান১০৫। আজ পৃথিবীর সর্বত্র সহিংসতা, অরাজকতা, সহনশীল পরিবেশের চরম অভাব রয়েছে শুধুমাত্র শুদ্ধ নৈতিকতা অনুপস্থিতির কারণে। বিখ্যাত সাহাবী হযরত কা’ব বিন আজুযাহ (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, মানবতার মুক্তির দিশারী নবী করীম (সাঃ) বলেছিলেন, ‘হে কা’ব, তোমাকে নির্বোধ লোকদের শাসন থেকে যেন আল্লাহতায়ালা হেফাজত করেন।

হযরত কা’ব বললেন, হে রাসূল (সাঃ)-নির্বোধ লোকদের শাসন বলতে কি বোঝায়? রাসূল (সাঃ) বললেন, আমার পরে এমন কিছু শাসক আসবে যারা আমার সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা, হেদায়াতকে অনুসরণ করবে না, আমার সুন্নতকে অনুকরণ করবে না। তারা অত্যাচার, অনাচার, পাপাচারে লিপ্ত থাকবে, যারা তাদের এই অত্যাচার, জুলুমকে সহযোগিতা করবে তাদের সাথে আমার এবং আমার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না, তারা আমার হাউজে কাউছারের ধারেকাছেও আসতে পারবে না। আর যারা তাদের এই অত্যাচার ও মিথ্যাচারকে প্রত্যাখান করবে এবং তাদের জুলুমের ব্যাপারে কোন সাহায্য করবে না, তারা আমার এবং আমি তাদের অন্তর্ভূক্ত। তারা পরকালে আমার হাউজে কাউছারের কাছে স্থান পাবে (আহমাদ, বাজ্‌জার)। এমন একটি দিন আসবে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং আল্লাহর কিতাব পৃথক হয়ে যাবে। আপনি যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে থাকেন, আপনার ঈমান থাকবে না, আর আল্লাহর কিতাবের পক্ষ থাকেন আপনার জান থাকবে না। এখন কি সেই দিন এসেছে? হ্যাঁ অবশ্যই এখন সেই দিন চলছে। বিখ্যাত সাহাবী হযরত মু’য়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) কে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, হে মু’য়াযতুমি কার পক্ষে থাকবে? রাষ্ট্র ব্যবস্থা নাকি আল্লাহর কিতাব। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি অবশ্যই আল্লাহর কিতাবের পক্ষে থাকবে। এখন ঈমান রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন বিষয়। জ্বলন্ত কয়লা যেমন হাতের উপর রাখা চরম সংকট, তেমনি বর্তমান যুগে আমারআপনার ঈমান রক্ষা করা ততোধিক সংকট ও কঠিন।

আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, আল্লাহর কোরআন এক ও অদ্বিতীয়, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত কিন্তু এর পরও আমরা মুসলিম জাতি আজ বহুধাবিভক্ত। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে এতবেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি যেন আল্লাহর অন্য ফরজ বিধানগুলো আমরা মানার চেষ্টাই করি না। ছোটখাটো মতবিরোধকে উপড়ে ফেলে ফরজ বিধানগুলো প্রতিষ্ঠায় আমরা চরমভাবে হীনস্মন্যতার পরিচয় দিই। অত্যাবশ্যকীয় ফরজ থেকে দূরে সরে পড়ি। মাদানী জীবনের সংকটকালীন মূহুর্তগুলোকে আমরা আমাদের জীবনের অংশ হিসাবে মানার মোটেই চেষ্টা করি না। অথচ মদিনায় ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং কোরআনের শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত আমাদের রাসূল (সাঃ) দেখিয়ে দিয়েছেন তার ছিটেফোঁটাও মেহনত করার চেষ্টা থেকে এদেশসহ সারা বিশ্বের আলেমওলামা, শিক্ষিত মহল যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছেন। এদেশের আলেম ওলামাদের অধিকাংশই ইক্বামতে দ্বীন নিয়ে জুমার খুতবায় কোন বক্তব্য প্রদান করেন না। কারণ একথা বলতে গেলে শাসক গোষ্টীর আঁতে ঘা লাগে এবং জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি হয়ে যায়। ওদিকে পদপদবী হারানোর ভয়ে অনেক খতিব হক কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। অথচ ইক্বামতে দ্বীনের শেষ পরিণতি হল শাসন ব্যবস্থায় আল্লাহর আইন তথা কোরআনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা। আর এটিই সকলের অগোচরে আমাদের আলেমওলামাগণ পাশ কাটিয়ে যান। তবে আশার খবর হচ্ছে যারাই এই দ্বীন প্রতিষ্ঠার কথা বলেতাদের উপরেই নেমে আসে ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতনের কাহিনী, অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে অবরুদ্ধ করে গোয়েবলসীয় কায়দায় অকথ্য নির্যাতনের ষ্টীম রোলার। হকপন্থী আলেমওলামাদের আহাযারিতে আল্লাহর আরশ যেন কেঁপে উঠে। মজলুমের ক্রন্দনে আন্দোলিত হয় বিশ্বময়। আর এটি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করছেন মহান আরশ থেকে মহাশক্তিধর আমাদের সৃষ্টিকর্তা। বিচারের নামে প্রহসন, অন্যায়ভাবে রায় দেওয়া বিচারকদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে সেই পরকালের বিচারালয়ের সামনে। কারণ, ‘আল্লাহতায়ালা কি সব বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক নন’?- সূরা আত্‌ তীন০৮। এদেশের মাটিতে যারাই ইক্বামতে দ্বীনের আন্দোলন করেছেন, তারাই শাহাদাতারে অমীয় সুধা পান করেছেন। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে দোঁয়েশ মাটি, এটেল মাটি। শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছেন হাজার হাজার দুঃসাহসী আলেমওলামা, ছাত্রশিক্ষক, বুদ্ধিজীবী মহল। অথচ সেই দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে থাকার পরও দ্বীন কায়েমের আন্দোলন থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। তবে এই আন্দোলন থামবার যেন নয়। এই কন্টকাকীর্ণ পথকে মাড়িয়ে, কাঁটাযুক্ত বনকে পেছনে ফেলে অদম্য সাহসে এগিয়ে যাওয়ার মত মানুষতো কম নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, এই মুসলিম সমাজে ৯৫% মুসলিম অধ্যুষিত এই জমিনে ইক্বামতের দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধাসমূহ চলমান থাকার কারণে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিক্ষণ দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকারীদের। অথচ এই দ্বীন কায়েমের প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে থাকার কারণে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে সেই মহান আরশের মালিকের কাছে। হয়তো যারা এই প্রতিষ্ঠার কাজে রত আছেন, তারা জীবদ্দশায় দ্বীন প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে না পারলেও মেহনত করার চেষ্টার উত্তম প্রতিদান মহান রাব্বুল ইজ্জত থেকে পাবেনআর এটাই শতভাগ গ্যারান্টি। আপনি মেহনতও করবেন না আর ওদিকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করবেনএটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মঞ্চে ময়দানে, আলেম সমাজের মধ্যকার কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, সহীহ্‌ হাদীস নিয়ে বিভ্রান্তি, কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথকে করেছে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত। সাধারণ মানুষ আজকাল ওয়াজ নসীহত থেকে অনেক দূরে সরে গেছে শুধুমাত্র আলেমদের মাঝে বিভেদের কারণে। অথচ এই বিভেদ না করার জন্যে এবং অনৈক্য সৃৃষ্টি না করার জন্যে আল্লাহর কোরআনে অনেকগুলো আয়াত রয়েছে, ‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রশিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধর এবং কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’সূরা ইমরান১০৩।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধমধুমাস জ্যৈষ্ঠ
পরবর্তী নিবন্ধজুলিও কুরি এবং বঙ্গবন্ধু