(পর্ব : ০২)
ইক্বামতে দ্বীন যে মহান রাব্বুল আ’লামীনের পক্ষ থেকে একটি ফরজ বিধান-সে ব্যাপারে প্রথম পর্বে আমি আংশিকভাবে উল্লেখ করেছি। হযরত মূসা (আঃ) তাঁর কওম বনী ইসরাঈলদেরকে সাথে নিয়ে যে মিশর গিয়েছিলেন তার অকাট্য দলিল রয়েছে আল্লাহর কোরআনে। সূরা ইউনূসের ৮৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহর ঘোষণা, ‘আমি মূসা ও তার ভাই হারুন এর কাছে (এই মর্মে) ওহী পাঠালাম যে, তোমরা তোমাদের জাতির (লোকদের) জন্যে মিসরেই ঘরবাড়ি বানাও এবং তোমাদের ঘরগুলোকে কেবলা (মুখী করে) বানাও, তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা করো এবং ঈমানদারদের (জান্নাতের) সুসংবাদ দাও’। প্রখ্যাত গবেষক ইমাম কুরতুবী (রাঃ) এর অভিমত: বনী ইসরাঈলগণ মিসরে ফিরে গিয়েছিলেন এবং ফেরআউন ও তার লোকদের সমস্ত ধনসম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এছাড়া বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ড. মোহাম্মদ হিযাযী আসসাকা বলছেন, ‘ফেরআউন সলিল সমাধিস্থ হও য়ার পর হযরত মূসা (আঃ) মিসর ফিরে গিয়েছিলেন এবং ১৩ বছর শাসন করেছিলেন। তিনি একাধিক উপাস্যের ধারণা বিলুপ্ত করেছিলেন, মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন অতঃপর একজন গভর্ণর নিযুক্ত করে তিনি সিনাই পর্বতে চলে যান। সেখান থেকে তাওরাত কিতাব লাভ করে এর একটি কপি ঐ গভর্ণরকে পাঠিয়ে দেন। ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত হাদীস থেকেও প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা ইক্বামতে দ্বীনেরই অংশ। হযরত জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূলে করীম (সাঃ) হযরত কা’ব বিন আযুজাহকে বললেন, ‘হে কা’ব, আল্লাহতায়ালা তোমাকে নির্বোধ লোকদের শাসন থেকে হেফাজত করুন। তিনি আরজ করলেন, নির্বোধ লোকদের শাসন কি ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)? রাসূলে করীম (সাঃ) বললেন, আমার পরে এমন কিছু শাসক আসবে যারা আমার পথনির্দেশনা বা হেদায়াতকে গ্রহণ করবে না, আমার সুন্নতের অনুকরণ করবে না। অতএব, যারা তাদের মিথ্যাচারকে বিশ্বাস করবে, জুলুম-অত্যাচার চালাতে তাদেরকে সাহায্য করবে, তাদের সাথে আমার, আমার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা আমার হাওজে কাউছারের কাছে আসতে পারবে না। আর যারা তাদের মিথ্যাচারকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং তাদেরকে জুলুমের ব্যাপারে সাহায্য করবে না, তারা আমার, আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত। তারা পরকালে আমার হাওজে কাউছারের কাছে স্থান পাবে’। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সত্য কিতাবে ইক্বামতে দ্বীন সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘(হে মানুষ) আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্যে সে বিধানই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহী করে পাঠিয়েছি, (উপরন্তু) যার আদেশ আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম (এদের সবাইকে আমি বলেছিলাম), তোমরা (এ) বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং (কখনো) এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না; (অবশ্য) তুমি যে (দ্বীনের) দিকে আহ্বান করছো, এটা মোশরেকদের কাছে একান্ত দুর্বিষহ। (মূলত) আল্লাহতায়ালা যাকেই চান তাকে বাছাই করে তাঁর নিজের দিকে নিয়ে আসেন এবং যে ব্যক্তি তাঁর অভিমুখী হয় তিনি তাকে (হেদায়াতের পথে) পরিচালিত করেন’। এখানে দ্বীন বলতে শুধুমাত্র নামায-রোজাকে বোঝানো হয়নি। পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। আর এজন্যেই এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ইমাম আ’স সাআদি বলছেন, ‘অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন-তোমরা যেন দ্বীনের মৌলিক শিক্ষাগুলো ও শাখা-প্রশাখা সব কিছুই প্রতিষ্ঠা করো। দ্বীন কায়েম করবে নিজেদের জীবনে। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে অন্যদের জীবনে বাস্তবায়নে। দ্বীনের ব্যাপকতা সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক ও চিন্তক ড. আবদুল করিম জাইদান বলছেন- ইসলামের গোটা শিক্ষা তিন ভাগে বিভক্ত ১। আক্বীদা সংক্রান্ত বিধিবিধান, ২। আখলাক সংক্রান্ত বিধিবিধান, ৩। ব্যবহারিক বিধিবিধান। ব্যবহারিক বিধিবিধান আবার দুই ভাগে বিভক্ত- ১। ইবাদত-যে সব বিধিবিধান স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক বিন্যাস করে, ২। মু’আমালা- যে সকল বিধান মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বিন্যাস করে। এগুলো আবার অনেক প্রকার- ১। পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত বিধিবিধান-যেগুলোকে আধুনিক আইনের পরিভাষায় বলা হয় পারসোনাল স্ট্যাটাস ল’ / ফ্যামিলি ল’। ২। অর্থনীতি লেনদেন সংক্রান্ত বিধিবিধান-যেগুলোকে বলা হয় সিভিল ল’, ৩। বিচার ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত বিধিবিধান-যেগুলোকে বলা হয় ল’ অব প্রসিডিউর, ৪। মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক বিন্যাসকারী ল’-যাকে বলা হয় প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল’, ৫। অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ক আইন-যাকে বলা হয় পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল’, ৬। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের ধরন, মূলনীতি, নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্র ও জনগণের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত আইন-যাকে বলা হয় কনস্টিটিউশনাল ল’, ৭। অপরাধ ও দন্ডবিধি সংক্রান্ত আইন-যাকে বলা হয় পেনাল কোড/ফৌজদারী আইন। মোট কথা, জীবনের এমন কোন দিক নেই যেখানে ইসলামের শাসন, অনুশাসন, বিধিবিধান ও নির্দেশনা নেই। এ সব কিছু নিয়েই ইসলাম, দ্বীন। তাই ইসলাম মানে শুধু কলেমা, নামায ও যাকাত। এর সাথে রাষ্ট্রের কোন সম্পর্ক নেই- এ কথা নাস্তিকদের মুখেই শোভা পায়।
লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল