আমাদের দেশে স্মৃতিচারণা বা ডায়েরি ভিত্তিক গ্রন্থের প্রকাশ খুব কম। গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ কবিতা এসব বিষয় অবলম্বনে। প্রকাশিত গ্রন্থের প্রাধান্য ও আধিক্য লক্ষ্যনীয়। আবার স্মৃতিচারণামূলক দুয়েকটি গ্রন্থ যাওবা প্রকাশিত হয় তাকে স্মৃতিচারকের ব্যক্তি প্রকাশই বেশি দেখা যায় পারিপাশ্বিকতার বর্ণনা ও উল্লেখের চেয়ে। অথচ দ্বিতীয়টির গুণে একটি স্মৃতিচারণা অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস তুল্য হয়ে ওঠে।
চলতি বছর (২০২৪, জানুয়ারি) চট্টগ্রাম সত্যজিৎ চর্চা কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছে ইকবাল করিম হাসনু রচিত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘কলকাতা ছুঁয়ে–ভারত ঘোরার দিনলিপি’ গ্রন্থটি লেখকের প্রথম ভারত ভ্রমণকালীন লিখিত ডায়েরির গ্রন্থরূপ। স্বাদু গদ্যে লেখা ভ্রমণকাহিনীতে লেখকের নিজের নানা অভিজ্ঞতার পাশাপাশি উঠে এসেছে তৎকালীন ভারতবর্ষের বেশকিছু অঞ্চলের পারিপার্শ্বিকতা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র যা সে সময়ের ভারতকে তুলে ধরে। হাসনু মূলত ১৯৮২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ উপলক্ষে কলকাতায় গিয়েছিলেন। এটি ছিল তার প্রথম বিদেশ সফর। অবশ্য বর্তমানে তিনি কয়েক দশক ধরে প্রবাসী (কানাডায়)। ১৯৮২ সালে তার বয়স মাত্র ২৪ বছর। তারুণ্যউত্তীর্ণ এই বয়সে তার পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং তা নির্মেদ গদ্যে লিখন রীতিমত পরিণত মনস্বিতার ইঙ্গিত দেয়। ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, যেভাবে সে সময়ে ডায়েরি লিখেছিলেন তিনি সেভাবেই ৪২ বছর সেটি মুদ্রিত হয়েছে পরবর্তী সময়ের কোনো সম্পাদনা ছাড়া।
ইকবাল করিম হাসনুর লেখালেখির সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা মানবেন, হাসনু তার লেখালেখির শুরু থেকেই আড়ম্বরহীন স্বল্প কথায় তার বক্তব্যকে তুলে ধরতে পারঙ্গম। এটা ঈর্ষণীয় ব্যাপার। এই বইটিতে তাই। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ছোট ছোট বর্ণনার মধ্যে দিয়ে এত আন্তরিকভাবে লেখা যা ছবির মতো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। বর্ণনার মধ্যে নানা রকম উইট লক্ষ্য করা যায় যা তার কৌতুকবোধের পরিচয় দেয়।
হাসনু যখন প্রথমবারের মতো বিদেশে বা ভারতে যায় তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে) ছাত্র। খুবই সামান্য কিছু অর্থের সংস্থান করে রীতিমতো সাহস করে সে বিদেশ ভ্রমণে যায়। বুদ্ধি খাটিয়ে সে বোহেমিয়ান টুরিস্টদের মতো একের পর এক দ্রষ্টব্য দর্শনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে যা একজন প্রকৃত পর্যটক কিংবা ভ্রমণ পিপাসুর বৈশিষ্ট্য। কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ তার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও সে দিল্লি, মুম্বাই, আগ্রা, ফতেপুর, আজমির মাদ্রাজ (চেন্নাই) সহ অনেক জায়গা ভ্রমণ তিনি করে নেন। বলা বাহুল্য প্রতিটি স্থানের ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্ত বিষয় তিনি তুলে ধরেন স্বল্প পরিসরে। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের প্রসঙ্গ খুব স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে বইয়ের শুরুর দিকে। আছে, ছবি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এই উৎসবটি আগে দু’বছর অন্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত হতো। বেশ কয়েক বছর আগে থেকে এটি এখন স্থায়ীভাবে গোয়াতে অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাপারটি মনে হয় ফ্রান্সের কান ফেস্টিভ্যালের অনুসরণে করা। পানাজি (গোয়ার রাজধানী) ও কান দুটোই সৈকত শহর। চলচ্চিত্র উৎসবের পাশাপাশি পর্যটনের দিকটাও এক্ষেত্রে খেয়ালে রাখা হয়েছে বলে মনে হয়। কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লিসহ ভারতের অন্যান্য বড় শহরে এখন চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয় পৃথকভাবে। এমনকি অনেক ছোটো ছোটো শহরেও। ব্যাপারটি চলচ্চিত্রের উৎকর্ষের চাইতে পর্যটনের দিকটাকে মাথায় রেখে করা বলে মনে হয়।
ইকবাল করিম হাসনু ১৯৮০ ও ৯০–এর দশকের একজন নিষ্ঠাবান চলচ্চিত্র সংসদকর্মী। প্রথমে চট্টগ্রামে পরে ঢাকায়। এই চট্টল সন্তানের পারিবারিক পটভূমিও রয়েছে তার পরিবারের দুই প্রজন্ম চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ছিলেন ১৯৭০, ৮০ ও ৯০–এর দশকে। স্বভাবতই তারমধ্যে তার ধারাবাহিকতা জারিত হয়েছে যা এখনও অব্যাহত। কানাডাতেও তিনি চলচ্চিত্র চর্চায় সংযুক্ত রয়েছেন। তার লেখা চলচ্চিত্র বিষয়ে ‘নিবন্ধ চলচ্চিত্র’ নামের একটি মুখপাঠ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে।
আলোচ্য গ্রন্থের ‘কলকাতা ছুয়ে ভারত ঘোরার দিনলিপি’ নামকরণে অভিনবত্ব রয়েছে। হাসনু ভারত ভ্রমণ করেছেন কলকাতাকে কেন্দ্র করে। ভারতের এ শহরটিকে ঠিক বিদেশ বলে অনুভূত হয় না বাংলাদেশের বাঙালিদের কাছে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত সাদৃশ্যের কারণে। হাসনুও তা লিখেছেন তার বইতে। তিনি ঢাকা থেকে প্রথমে কলকাতা গিয়ে তারপর ভারতের অন্যান্য স্থানে ভ্রমণ করে ফিরেছেনও সেভাবে। ফলে নামকরণটি যুৎসই। বইটির অঙ্গসজ্জাও আকর্ষণীয় রয়েল ডিমাই আকারের সাড়ে তিন ফর্মার বইটি হাতে নিলে বেশ আকর্ষণীয় বোধ হয়। এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অগ্রজ প্রাজ্ঞ আবুল মোমেনের লেখা ‘স্মৃতি ও প্রীতি’ শিরোনামের মুখ বন্ধ। আবুল মোমেন সম্পর্কে ইকবাল করিম হাসনুর আপন খালাতো ভাই। তিনি তাঁর মুখবন্ধে হাসনুর বেড়ে ওঠা নিয়ে চিত্তাকর্ষক এক বর্ণনার উপস্থাপন করেছেন যার একটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হাসনুর নিজের লেখা ভূমিকা ‘কৈফিয়ত’ যা বইটির প্রাসঙ্গিকতাকে অর্থবহ করে তোলে। আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্রজন আনোয়ার হোসেন পিন্টু যিনি এই গ্রন্থের প্রকাশক এবং হাসনু সুহৃদ। সুমিত পালের অলংকরণও উন্নতমানের। সে তুলনায় জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রমাদ সংশোধন আরও মনোনিবেশ দাবি করে। যেমন ৩৭ পৃষ্ঠার প্রথম পংক্তিতে বাক্যচ্যুতি পীড়াদায়ক। বাক্যটি অসমাপ্ত এবং সম্ভবত এই বাক্যের ধারাবাহিকতায় আরও কিছু কথা অবশিষ্ট রয়ে গেছে। রঞ্জন প্রকাশনের মুদ্রণ সৌষ্টব দৃষ্টিনন্দন। ১৯৮২ সালে হাসনুর কলকাতা ভ্রমণকালে তিনি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছিলেন। তারই বিস্তৃত রূপ আমরা ৪২ বছর পর পেলাম। সব মিলিয়ে সুন্দর একটি গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্যে লেখক, প্রকাশক ও মুদ্রককে আন্তরিক ধন্যবাদ।