ইউরিক এসিড নিয়ন্ত্রণে খাবার সতর্কতা

মোঃ ইকবাল হোসেন | শনিবার , ৩ মে, ২০২৫ at ৭:০১ পূর্বাহ্ণ

শরীরে অনেক ধরনের ব্যথার মধ্যে একটি হচ্ছে জয়েন্ট পেইন, অর্থাৎ হাড়ের জোড়ায় ব্যথা। এই ব্যথার অনেক কারণ থাকতে পারে, তার মধ্যে রক্তে ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়া অন্যতম। পিউরিন সমৃদ্ধ খাবারের উপজাত হিসাবে ইউরিক এসিড তৈরি হয়। বেশিরভাগ ইউরিক এসিডই রক্তের সাথে মিশে কিডনির মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু উপজাত হিসাবে যখন অতিরিক্ত পরিমাণে ইউরিক এসিড তৈরি হয় তখন কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

আমাদের শরীরে ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে, পুরুষদের জন্য ৩.৭ মি.গ্রা./ডিএল এবং মেয়েদের জন্য ২..৭ মি.গ্রা./ডিএল। এই মাত্রা অতিক্রম করলেই জয়েন্ট পেইনসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। আগে এই সমস্যা শুধু বয়স্কদের মধ্যে দেখা গেলেও এখন কম বয়সীদের মাঝেও ইউরিক এসিড বাড়তির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যভ্যাস। আর শীতের সময় এর প্রকোপ কিছুটা হলেও বাড়ে। কারণ ইউরিক এসিড বাড়ায় এমন খাবারের একটা বড় অংশ শীতকালে বেশি পাওয়া যায় এবং খাওয়া হয়।

কেন বাড়ে ইউরিক এসিড?

১ ॥ আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খেলে সেখান বেশি ইউরিক এসিড তৈরি হয়।

২ ॥ কোষ বিপাক ক্রিয়ায় উপজাত হিসাবে ইউরিক এসিড বেশি পরিমাণে তৈরি হলে।

৩ ॥ কিডনি রোগ থাকলে কিডনি পর্যাপ্ত ইউরিক এসিড শরীর থেকে নিষ্কাশন করতে না পারলে ইউরিক এসিড বেড়ে যেতে পারে

৪ ॥ শরীরে ইউরিক এসিড বিপাকের এনজাইমে ঘাটতির ফলে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড তৈরি হলে।

৫ ॥ শরীরের ওজন বেশি হলে।

৬ ॥ বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হিসাবে ইউরিক এসিড বাড়ে।

৭ ॥ পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে।

৮ ॥ নিয়মিত ব্যায়াম না করলে এবং পানি কম খেলে।

৯ ॥ ধুমপান বা কোনো নেশাজাতীয় দ্রব গ্রহণ করলে।

১০ ॥ অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যভ্যাস।

কী সমস্যা হয়?

রক্তে থাকা ইউরিক এসিড বেশি থাকলে তা হাড়ের জয়েন্টের চারপাশে ক্রিস্টাল আকারে জমা হয়। ফলে হাঁটা চলা করতে গেলে খুব ব্যথা অনুভুত হয়। ইউরিক এসিড বৃদ্ধির কারণে কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে সেইসাথে হজম প্রক্রিয়াও বিঘ্নিত হতে পারে। সময়মতো ইউরিক এসিডের সমস্যা ধরা না পড়লে, গুরুতর সমস্যা হতে পারে। যেমন অনিয়ন্ত্রিত ইউরিক এসিড থাকলে হার্টের অসুখ এবং কিডনিতে পাথর হতে পারে। বিশেষ করে পায়ের জয়েন্টগুলো লাল হয়ে ফুলে যেতে পারে। গোড়ালি ব্যথা হতে পারে। সারাদিন হাঁটাচলার কারণে ইউরিক এসিডের ক্রিস্টাল জমা হতে পারে না। কিন্তু রাতে ঘুমের মধ্যে এই ক্রিস্টাল সবচেয়ে বেশি জমা হয়। তাই সকালে ইউরিক এসিডের কারণে ব্যথা সবচেয়ে বেশি অনুভুত হয়। ঘুম থেকে উঠে হাঁটা শুরু করলে কাঁটা ফোটার মত অনুভূতি হয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় হাঁটুতে, অর্থাৎ হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যায়। এছাড়াও ঘাড়ব্যথা এবং সাইনুভ্যিয়্যাল অস্থিসন্ধিতেও ব্যথা হতে পারে।

যেসব খাবার ইউরিক এসিড বাড়ায়

সব ধরনের অর্গান মিটে ইউরিক এসিড বেশি বাড়ে। কলিজা, গুর্দা, মগজ, পায়া, ভুড়ি, মাছের ডিম, সামুদ্রিক মাছ, গরুখাসির মাংস, হাঁস বা ভেড়ার মাংস, ফুসফুস, মাশরুম, হাসমুরগির চামড়া, কাঁকড়া, সামুদ্রিক শুঁটকি, ইলিশ মাছ। এসব খাবারে ইউরিক এসিড সবচেয়ে বেশি বাড়ে। তাই এসকল খাবার কিছুদিনের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।

মটর ডাল, বুটের ডাল, চটপটির ডাল, সিমের বীচি, কাঁঠালের বিচি, মটরশুটি। এসব খাবারেও ইউরিক এসিড বাড়ে।

শতমূলী, পুঁই শাক, পালং শাক, সরিষারশাক, মুলা শাক, পাট শাক, কচুরশাক, কচুরলতি।

ক্রুসিফেরি গোত্রের উদ্ভিদসমূহ

ফুলকপি, ব্রোকলি, ঢ়েঁড়স, ওলকপি, টমেটো, সজনে, শালগম, মাশরুম, বেগুন রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমান বৃদ্ধি করে।

অতিরিক্ত লবণযুক্ত (প্যাকেটজাত খাবার), চর্বিযুক্ত, তেলে ভাজা খাবার, ইস্ট বা ইস্টের খাবার ইউরিক এসিড বাড়ায়।

কী খাবেন

প্রোটিন জাতীয় খাবারের চাহিদা মেটাতে মিঠা পানির মাছ ও চামড়া ছাড়া মুরগীর মাংস, ডিম, মুগডাল, মুসুরডাল, টক দই, দুধ খেতে হবে পরিমিত পরিমানে। এসব খাবার পরিমিত পারিমানে খেলে ইউরিক এসিড বাড়বে না।

শাকসবজিলাল শাক, ডাটা শাক, লাউ শাক, কলমি শাক, কুমড়া শাক, সবুজ শাক। কাঁকরোল, পেঁপে, ধুন্দল, চিচিঙ্গা, পটল, করলা, লাউ, চাল কুমড়ো ইত্যাদি। এসকল খাবারে ইউরিক এসিড বাড়ে না।

সেই সাথে সব ধরনের মৌসুমী ফল খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। আমড়া, আমলকি, জাম্বুরা, জলপাই, কাঁচা পেয়ারা, কচি ডাবের পানি এগুলো বেশি খেতে হবে। এসব খাবার ইউরিক এসিড কমাতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। পানি অতিরিক্ত ইউরিক এসিডকে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। গ্রীন টি ইউরিক এসিট কমাতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন অন্তত ২ বার গ্রীন টি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।

করণীয় কী?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইউরিক এসিড বাড়তে তেমন জটিলতা তৈরি হয় না, তবুও সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি একজন বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে খাদ্যভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন খাবারে বিধি নিষেধ থাকতে পারে। তাই খাদ্যভ্যাসের ব্যাপারে সঠিক পরামর্শ পেতে একজন বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উত্তম।

লেখক : জ্যৈষ্ঠ পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধমর্যাদা হোক শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে