আড়াই বছর পার, ভবনের কাজ শুরুই হলো না

বাকলিয়া সরকারি কলেজ ।। ঠিকাদার কার্যাদেশ বাতিলের সুযোগ আছে এটা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ব্যর্থতা : কলেজ কর্তৃপক্ষ

রতন বড়ুয়া | বুধবার , ১২ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

অবকাঠামো সংকটে প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বেহাল অবস্থা বাকলিয়া সরকারি কলেজের। চারতলার একটি মাত্র পুরনো ভবন সম্বল কলেজটির। গভঃমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট থাকাকালীন সব মিলিয়ে হাজারখানেক শিক্ষার্থীর পাঠদান চলছিল এ ভবনে। ২০১৬ সালে সরকারি কলেজে রূপান্তরের পর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে এখন তিন গুণ। তবে তিন গুণ বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রমও চলছে এই একটি ভবনে। গত ৪/৫ বছর ধরে এমন দুরবস্থার মধ্যেই চলছে সরকারি কলেজটি। কলেজটির অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে উদ্যোগ নেয় সরকার। নতুন একটি ভবন নির্মাণে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে কার্যাদেশও দেয়া হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এর কার্যাদেশ দেয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। কার্যাদেশ পায় এম এন ট্রেডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কার্যাদেশের আড়াই বছর পার হলেও ভবনটির নির্মাণ কাজ এখনো শুরু হয়নি। এ নিয়ে গত বছরের ১৬ জুলাই দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘সংকটে বেহাল বাকলিয়া সরকারি কলেজ/কার্যাদেশের দুই বছরেও শুরু হয়নি নতুন ভবনের নির্মাণকাজ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কয়েকদিন এ নিয়ে তোড়জোড় চলে। কলেজ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত কাজ শুরুর আশ্বাস দেয় শিক্ষা প্রকৌশল ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টরা। তবে ওটুকুই। কাজ আর শুরু হয়নি। পরে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ‘বাকলিয়া সরকারি কলেজ : ভবনটি নির্মাণ হবে কবে/কাজই শুরু করেনি ঠিকাদার/শিক্ষা প্রকৌশলের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন’ শিরোনামে আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় আজাদীতে। দুটি প্রতিবেদনেই নির্মাণ কাজ শুরু করতে চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার সরকার। কিন্তু আজ পর্যন্ত ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্যাদেশ প্রদানের পরপরই কাজ শুরু করার নিয়ম রয়েছে। খুব বেশি দেরি করার সুযোগ নেই। কাজ শুরু করতে গড়িমসি করলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চাইলে কার্যাদেশ বাতিল করতে পারে। কার্যাদেশ বাতিলপূর্বক ভবনটি নির্মাণে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে পারে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ‘কালো তালিকাভুক্ত করার সুযোগও রয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের।

এর আগে আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দিন এ বিষয়ে বলেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে এতটা দেরি হওয়ার কথা না। কার্যাদেশ দেয়ার পরও কাজ শুরুতে বিলম্ব হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেয়া কার্যাদেশ বাতিল করার সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনে নতুন করে টেন্ডার আহ্বানও করা যায়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চাইলে যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে।

কিন্তু কার্যাদেশের পর আড়াই বছর পার করলেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থার তথ্য জানা যায়নি। এ ঘটনায় শিক্ষা প্রকৌশলের অক্ষমতা ও প্রশাসনিক অদক্ষতাকে দুষছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর জসিম উদ্দিন খান বলেন, এটি সম্পূর্ণ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা। তাদের কারণেই ঠিকাদার এই গড়িমসির সুযোগ পাচ্ছেন এবং নিচ্ছেন। অথচ ক্লাসরুম সংকটে আমাদের বেহাল অবস্থা। আমরা শিক্ষার্থীদের ক্লাস করাতে পারছি না। ছাত্রছাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত বাথরুমের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষকদেরও ঠিকমতো বসার জায়গা নেই। সব মিলিয়ে শোচনীয় অবস্থায় দিন পার করছি। কিন্তু শিক্ষা প্রকৌশলের উনারা দিনের পর দিন শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নতুন ভবনটি হবে ৬ তলা বিশিষ্ট। তবে শুরুতে পাইলিং ও নিচতলার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এক কোটি টাকার এ প্রকল্পের কার্যাদেশ পেয়েছে এম এন ট্রেডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

প্রথম তলার নির্মাণ কাজ শেষ হলে পরবর্তীতে উপরের তলার টেন্ডার আহ্বান ও কার্যাদেশ দেয়া হবে বলে জানায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। গত বছরের ১৬ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে কার্যাদেশ পাওয়া এম এন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ইমতিয়াজ উদ্দিন দাবি করেন, কাজটি তারা পেয়েছেন ঠিকই। তবে ‘প্রভাবশালী’ একজনের অনুরোধে আরেক পার্টিকে কাজটি দেয়া হয়েছে। তারাই কাজটি করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এম এন ট্রেডার্স কাজটি পেলেও ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা (বর্তমানে মহানগর যুবলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত) কাজটি নিয়ে নেন। মূলত তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই নির্মাণ কাজটি হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যাদেশের পর আড়াই বছর পার হলেও ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।

এ বিষয়ে কথা বলতে কাগজেকলমে কার্যাদেশ পাওয়া এম এন ট্রেডার্সের ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ইমতিয়াজ উদ্দিনের মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রথম দফায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে গত বছরের ১৬ জুলাই আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার সরকার দাবি করেন, তার দায়িত্বভার গ্রহণের আগে থেকেই কাজটি স্তিমিত ছিল। সে বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে পারবেন না। তবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্মাণ কাজ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলেছেন।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভবনটি নির্মাণে কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় নির্বাহী প্রকৌশলী পদে ছিলেন মো. জালাল উদ্দিন। ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর এ পদে যোগ দেন প্রদীপ কুমার সরকার। যোগদানের পর দেড় বছরের বেশি সময় পার করেছেন তিনি। ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু করতে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানালেও এর দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ মেলেনি। ঠিকাদারের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

কয়েকদিন আগে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রদীপ কুমার সরকার দাবি করেন, তিনি চেষ্টা করছেন।

কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কলেজের বিদ্যমান পুরনো ভবনের ডান পাশে গত বছরের জুনে একটি পাইলিংয়ের কাজ করা হয়েছে। আর বালি স্তূপ করা হয়েছে। কিন্তু এরপর নির্মাণ কাজের সাথে সংশ্লিষ্টদের আর দেখা যায়নি। পাইলিংয়ের জন্য আনা যন্ত্রটিও কিছুদিন আগে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দীর্ঘ সময় পরও নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কলেজের শিক্ষকশিক্ষার্থীরা।

কলেজ কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, বর্তমানে চারতলা যে ভবনটিতে শ্রেণি কার্যক্রম চলছে সেটি গভঃমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট থাকাকালীন পুরনো ভবন। গভঃমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটে কেবল ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ছিল সর্বোচ্চ এক হাজার। ২০১৬ সালে সরকারি কলেজে রূপান্তরের পর তিন বিভাগে (বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকে) শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। প্রথম বছর (২০১৬ সালে) কেবল একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করানোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কম ছিল। পরের বছর থেকে দুই বর্ষে (একাদশ ও দ্বাদশ) মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। পরে পর্যায়ক্রমে আসন সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কলেজটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রথম বছরের তুলনায় এখন প্রায় তিন গুণ। বছর বছর শিক্ষার্থী বাড়লেও অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা বাড়েনি। ইনস্টিটিউট থাকাকালীন পুরনো একমাত্র ভবনটিতেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যমান চারতলা ভবনটির নিচতলা জুড়ে রয়েছে প্রশাসনিক ব্লক। যেখানে ছোট্ট একটি কক্ষে বানানো হয়েছে অধ্যক্ষের কার্যালয়। রয়েছে শিক্ষক মিলনায়তন ও লাইব্রেরি। ছাত্রীদের কমনরুমও নিচতলায়। নিচতলায় ক্লাস নেয়ার উপযোগী কোনো কক্ষ অবশিষ্ট নেই। বাকি তিনটি ফ্লোরে মোট ৮টি কক্ষ রয়েছে ক্লাস নেয়ার উপযোগী। প্রতিটি ক্লাস রুমে ৭০/৮০ জনের বেশি শিক্ষার্থী বসানোর সুযোগ নেই। একটি ক্লাস রুমকে বানানো হয়েছে ল্যাব।

কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জসিম উদ্দিন খানসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। কলেজের নানাবিধ সংকটের কথা তুলে ধরে তারা বলেন, আগে সর্বোচ্চ এক হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদানের জন্য এই ভবনটি উপযোগী ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষার্থী প্রায় তিন গুণ। সে হিসেবে কয়েক গুণ বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে গেলে নতুন অবকাঠামোভবন জরুরি। কিন্তু টেন্ডারকার্যাদেশ সম্পন্ন হলেও নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। এর জন্য কলেজকে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শ্রেণি কক্ষ সংকটে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। একটি সেকশনকে দুটি করে পাঠদান করতে হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জোরালো উদাহরণ তৈরি করুক বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধনতুন রাষ্ট্রপতির শপথ ২৪ এপ্রিল