গবেষক, কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনুর মৃত্যুর শোকের আঘাত কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকজন গবেষক আহমদ মমতাজ চলে গেলেন। ৬১ বছল বয়সে মমতাজের জীবনের রথ থেমে গেল। মমতাজ কৃতী গবেষক ছিলেন: বাংলার ছাত্র ইতিহাসের গবেষক। বাংলা সাহিত্য নিয়েও কম কাজ করেননি।
ঐতিহাসিক প্রফেসর ড. আবদুল করিম মমতাজকে ইতিহাস চর্চায় উৎসাহ ও প্রেরণা জোগান। শুধু মমতাজ নয়, আরো অনেক ছাত্রকে করিম সাহেব ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। তিনি যখন শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রকে নিয়ে পুরাকীর্তির সন্ধানে নেমেছিলেন। সুলতানী আমলে, মোগল আমলে নির্মিত বহু মসজিদ তিনি খুঁজে খুঁজে বের করেন এবং সেগুলির গাত্রে উৎকীর্ণ শিলালিপি উদ্ধার করে তার পাঠও নির্ণয় করেন। মমতাজও হয়তো সেই টিমের সংগে যুক্ত হয়েছিলেন এবং তখন থেকেই তিনি ইতিহাসের গবেষণা ও অনুসন্ধানে ব্রতী হন।
মমতাজের লেখালেখির শুরু একেবারে ছোটবেলায়, নবম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায়। প্রথমে ছোটগল্প, পরবর্তীকালে রম্য গল্প ও প্রবন্ধ রচনায় হাত পাকান আশির দশকে ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ক তথ্য-উপকরণ সংগ্রহ শুরু করেন, ১৯৯২ সালের পর এই বিষয়ে পুরোদমে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক ৬ শতাধিক প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নাল, জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে বড় অংশই চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি-সাহিত্য বিষয়ক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ৭টি। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে মীরসরাই’র ইতিহাস- সমাজ ও সংস্কৃতি, “শমসের গাজী ” দুই খণ্ডে চট্টগ্রামের সুফী সাধক ও বদর শাহ, চট্টগ্রামের মনীষীদের জীবন বৃত্তান্ত সংকলন “ চট্টল মনীষা” উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম, দুই বাংলার সুফী সাধক বদর শাহ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-মরণজয়ী উপাখ্যানসহ ২০টি গ্রন্থ নিয়ে তিনি কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে সে কাজগুলো হয়তো আমরা আর ছাপার অক্ষরে দেখতে পাবো না। এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়ায় (দ্বিতীয় সংস্করণ) ১২টির বেশি ভুক্তি ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা ২০০৭ (নবম খণ্ড) চট্টগ্রামের প্রবাদ-প্রবচনের লেখক-সংগ্রাহক যুগ্মভাবে আহমদ মমতাজ ও রাইহান নাসরিন।
তাঁর স্ত্রী রাইহান নাসরিন একজন উচ্চশিক্ষিত বিদূষী নারী। নাসরিন এর সঙ্গে বিয়ে মমতাজের জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছিলো। নাসরিন তাঁর লেখালেখি ও গবেষণাকর্মের সহযাত্রী হয়। নাসরিন শুধু তাঁর গবেষণা ও লেখালেখিতে উৎসাহ জোগাননি, নিজেও কলম ধরেছিলেন। সহধর্মিনীর সাহচর্য মমতাজের সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে আরো উস্কে দিয়েছিল। তাদের যৌথ গবেষণাকর্মের ফসল ‘চট্টগ্রামের লোক সাহিত্য ও লোকজ জীবন বিষয়ক’ সংগ্রহের একাংশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রকল্প (খন্ড ৯, প্রকাশ-২০০৯) ‘চট্টগ্রামের প্রবাদ প্রবচন’ অধ্যায়ে প্রকাশিত হয়। ২০১২ সালে বাংলাপিডিয়ার দ্বিতীয় সংস্করণে মমতাজের বেশ কিছু ভুক্তি অন্তর্ভুক্ত হয়।
২০১২ সালে বাংলা একাডেমীর একটি প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম জেলার লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক সংগ্রহ-গবেষণার দায়িত্ব নিয়ে মমতাজ-নাসরিন দম্পতি সমগ্র চট্টগ্রাম ঘুরে বেড়ান। মমতাজ চট্টগ্রাম সমিতি- ঢাকা-এর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সমিতির শতবর্ষ স্মারক সংকলন প্রকাশ মমতাজের মেধার অত্যুৎকৃষ্ট প্রকাশ।
আহমদ মমতাজ এর জন্ম ১৯৬০ সালের ২০ জুন চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর গ্রামে। বাবা- মোহাম্মদ আবদুল বারি, মা আমেনা খাতুন।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ১৯৮১ ও এম এ ১৯৮২ (বাংলা) ডিগ্রি নেন। লেখাপড়া শেষ করার পর প্রথমে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন। পরে ব্যাংকে চাকরি নেন। একই সময়ে সংবাদকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৯২ সালে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের সাথে যুক্ত হন। পাশাপাশি গবেষণা ও লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন।
আহমদ মমতাজ বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, ইতিহাস একাডেমী (নির্বাহী সদস্য), ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম, চট্টগ্রাম একাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, আন্তর্জাতিক লেখক ফোরাম চঊঘ (নির্বাহী সদস্য), সিজেএফডি, মীরসরাই প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা (প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক) সহ বহু মননশীল শিক্ষা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ ও ভারতে বেশ কয়েকটি সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি বেশ কিছু সংখ্যক স্মারক-সংবর্ধনা গ্রন্থের সম্পাদক। তিনি ঢাকাস্থ মীরসরাই সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পাদটীকা ঃ অদৃষ্ট বা নিয়তির কাছে মানুষ সব সময় অসহায় ছিলো। যার যা নিয়তি, তাতেই ব্যক্তি মানুষের পরিণতি। রোগব্যাধির যখন কোন প্রতিকার ছিলো না, তাতেও মানুষ হয়তো অদৃষ্ট হিসেবে মেনে নিতো। কিন্তু নিয়তির কাছে হার মানলেও রোগব্যাধির কাছে মানুষ সহজে হার মানতে চায়নি। মানব ইতিহাসে কালে কালে বিভিন্ন রোগ মহামারী আকারে আবির্ভূত হয়েছে। প্লেগ, বসন্ত, কলেরা, কালাজ্বর ইত্যাদি রোগ যখন মহামারী রূপে মানব সমাজকে আক্রমণ করে শহর, বন্দর, গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছিল, তখনও মানুষ চেষ্টা করেছে মহামারী থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সাধনা ব্যর্থ হয়নি, ঠিকই একসময় তারা প্রতিষেধক আবিষ্কার করে মহামারী থেকে মানব সমাজের পরিত্রাণ লাভের পথ খুঁজে বের করেছে । কিন্তু অধুনা কোভিড-১৯ যেন অজেয় মহামারী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কিছুতেই এই মহামারীর হাত থেকে মানুষ নিস্তার পাচ্ছি না। মানুষ কী হেরে যাচ্ছে? কোভিডের টিকা আবিষ্কার করেছে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত ইত্যাদি দেশ। কিন্তু তাতে রোগের বিস্তার, সংক্রমণ তো কমছে না।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক