চট্টগ্রামের মানুষের মায়ের ভাষায় রচিত গানকে ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান’ বলা হয়। এই গান বাংলা লোকসংগীতের এক সমৃদ্ধ ধারা। একান্তই চট্টগ্রামের নিজস্ব সংগীতধারা বলে এই গানকে কিংবদন্তী সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালী ‘চাটগাঁইয়া গান’ বলে অভিহিত করতেন।
আঞ্চলিক গানে ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক’ বলে একটা টার্ম আছে এটা সত্য। সাম্প্রতিক সময়ে কোন কোন গবেষক এই ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ গান নিয়ে লেখালেখি করছেন, লেখায় তথ্যনিষ্ঠতার ঘাটতি থাকায় তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না শামসুল আরেফীন একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী গবেষক। তাঁর গবষেণা বহুমাত্রিক। চলতি বছর তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একুশে সম্মাননা স্মারকে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বীকারোক্তি মতে, ‘সঠিক কারণ’ না জেনে এবং ‘ধারণাবশত’ তিনি লিজেন্ডদের গানকে যেভাবে ঢালাও ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ বলছেন, তা দুঃখজনক।
গত ২২ মার্চ দৈনিক আজাদীর সাহিত্য পাতায় লেখক–গবেষক শামসুল আরেফীনের ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের চাটগাঁইয়া গান’ এবং ৩ মে ‘সৈয়দ মহিউদ্দিন (মহি আল ভাণ্ডারী)র প্রস্থান’ শীর্ষক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীতে ‘চট্টগ্রামের কাউয়া আঞ্চলিক গান’ শিরোনামে আরেফীনের আরেকটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। প্রবন্ধগুলোতে চাটগাঁইয়া গানের রূপকার প্রয়াত আস্কর আলী পণ্ডিত, কবিয়াল রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাছির, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মলয় ঘোষ দস্তিদার, এম এন আখতার, আবদুল গফুর হালী, সঞ্জিত আচার্য্যসহ আরও কয়েকজন কিংবদন্তীতুল্য গীতিকারের গানকে ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ অভিধা দেওয়া হয়েছে, যা অনভিপ্রেত।
প্রথমেই বলে নিই, চাটগাঁইয়া গানের ভুবনে ক্ষেত্রবিশেষে ‘হালদাফাডা গান’ ও ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ হলো গালি, দুটি শব্দই চট্টগ্রামের মানুষের কাছে নেতিবাচক। আঞ্চলিক গানের জীবন্ত কিংবদন্তী সঞ্জিত আচার্য্য ও কল্যাণী ঘোষের মতে, সত্তরের দশকে আঞ্চলিক গানের স্বর্ণযুগে, এই গানকে সমাজের একটি শ্রেণি ‘অপসংস্কৃতি’ মনে করত, তারা এই গানকে ‘অশ্লীল’ এবং ‘গুরুচণ্ডালী’ প্রমাণ করতে দুটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করত একটি হলো, ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ অন্যটি ‘হালদাফাডা গান’। তাই আস্কর আলী পণ্ডিত, রমেশ শীল, মলয় ঘোষ দস্তিদার ও গফুর হালীসহ অন্য কিংবদন্তীদের গানকে ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ বললে তাদের প্রতি অসম্মান করা হয়। এবং তা শামসুল আরেফীনও তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন ‘শুদ্ধ বাংলার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে রচিত গানকে কাউয়া আঞ্চলিক গান বলা হতো কেন, তার সঠিক কারণসমূহ আমাদের জানা নেই। তবে ধারণা করতে পারি, প্রাগুক্ত আদিরসাত্মক এবং বিকৃতি রুচি ও অশ্লীলতাযুক্ত গানগুলোই ছিল মূল কারণ। ‘কাউয়া’ শব্দ থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের গানকে এই শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে চরম উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অসম্মানিত করা হতো।’ ( সূত্র:
চট্টগ্রামের লোকসংগীত, শামসুল আরেফীন)।
গত ২২ মার্চ দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের চাটগাঁইয়া গান’ প্রবন্ধে আরেফীন লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে বিশুদ্ধ আঞ্চলিক গান কখন থেকে রচিত হচ্ছে, তা বলা মুশকিল। আস্কর আলী পণ্ডিতের ক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে, তিনি কাউয়া আঞ্চলিক গান রচনা করলেও কোনো বিশুদ্ধ আঞ্চলিক গান বা চাটগাঁইয়া গান রচনা করেননি। তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে প্রকাশিত তাঁর কোনো পুঁথি বা সংগীতগ্রন্থে চাটগাঁইয়া গান অলক্ষ। … আস্কর আলী পণ্ডিত ছাড়াও তাঁর পরবর্তীকালে আরও অনেকে কাউয়া আঞ্চলিক গান লিখেছেন। যেমন, রমেশ শীল, মলয় ঘোষ দস্তিদার, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মোহনলাল দাশ, এম এন আকতার, গফুর হালী ও সঞ্জিত আচার্য প্রমুখ।’
এখানে আরেফীন কিংবদন্তীদের গানকে ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ প্রমাণে পূর্বসূরী কোন গবেষকের রেফারেন্সও দেননি।
কাউয়া আঞ্চলিক গান :
কাউয়া আঞ্চলিক গানের সংজ্ঞা কী? কাউয়া আঞ্চলিক গান নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। এমনকি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কল্যাণী ঘোষ সম্পাদিত ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান’ গ্রন্থে আঞ্চলিক গানকে ২০টি শে্রিণভাগে ভাগ করা হলেও সেখানে এই গানের কোন উল্লেখ নেই। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত, অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ সম্পাদিত ‘রমেশ শীল রচনাবলীতে’ও কবিয়ালের কোন গানকে ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ বলা হয়নি। তবে ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম একাডেমি প্রকাশিত ও ড. আনোয়ারা আলম সম্পাদিত ‘শ্যামসুন্দর–শেফালী ঘোষ’ স্মারকগ্রন্থে সংগীতজ্ঞ সৈয়দ মহিউদ্দিনের জবানিতে ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ প্রসঙ্গটি সংজ্ঞাসহ উল্লেখ আছে, যেটা শামসুল আরেফীন প্রদত্ত সংজ্ঞার বিপরীত। আরেফীন আজাদীতে প্রকাশিত তার দুটি লেখায় এই গানের দুই রকম ব্যাখা দিয়েছেন। ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের চাটগাঁইয়া গান’ প্রবন্ধে তিনি ‘শুদ্ধ বাংলার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে রচিত গানকে কাউয়া আঞ্চলিক গান বলা হতো’ উল্লেখ করলেও ‘মহি আল ভাণ্ডারীর প্রস্থান’ প্রবন্ধে বলেছেন উল্টো কথা ‘কিন্তু সৈয়দ মহিউদ্দিন ও তাদের মধ্যে (অন্য লিজেন্ড শিল্পী) একটি বড় পার্থক্য রয়েছে, …তিনি চাটগাঁইয়া গান রচনায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে অন্য কোন ভাষার মিশ্রণ ঘটান নি’। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কোনটা ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’? ‘শুদ্ধ বাংলার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে রচিত গান’ না ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে অন্য কোন ভাষার মিশ্রণে’ রচিত গান? আরেফীনের সংজ্ঞা দুটি সংঘাতপূর্ণ।
অন্যদিকে, চাটগাঁইয়া গান হলো চট্টগ্রামেরই নিজস্ব সংগীত ধারা যেমন আঞ্চলিক গান, মাইজভাণ্ডারী গান, জাঁহাগীরি গীত, মোহছেন আউলিয়ার গান, হঁলা, হাইল্যা গান, গোরপ পোয়ার গান, উল্টা গান ইত্যাদি। ধামাইল যেমন সিলেটি সংগীতধারা, ভাওয়াইয়া যেমন রংপুর এবং কোচবিহারে প্রচলিত একপ্রকার পল্লীগীতি, তেমনি আঞ্চলিক মাইজভাণ্ডারী, হঁলাও একান্তই চট্টগ্রামেরই সংগীতধারা, এগুলোই চাটগাঁইয়া গান।
এবার আসা যাক কাউয়া আঞ্চলিক গান প্রসঙ্গে।
সদ্য প্রয়াত সংগীতজ্ঞ সৈয়দ মহিউদ্দিন ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ এর একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন, পড়ুন তার জবানিতে, ‘‘রেডিওতে দেখা হয়, শেফালী দি কিছু বলতে চান।…একটা সময়ে তিনি বললেন, ‘মহী খালি শ্যামকে দিলে হবে? আমাকে কিছু দেবেন না? আমি জানতাম, যে সমস্ত গীতিকার শেফালীদির জন্য আঞ্চলিক গান লেখেন, সেখানে উনার স্বামী ননী বাবু হস্তক্ষেপ করেন। অর্থাৎ লোকে বোঝার জন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সাথে শুদ্ধ ভাষার (প্রমিত বাংলা) মিশ্রণ ঘটতে থাকে। আমি বলি ‘কাউয়া’ গান। …শর্ত দিলাম দিদিকে, আপনার জন্য গান লিখব, কিন্তু ননী বাবুর হাতে দিতে পারবেন না, উনি রাজী হলেন।’ (পৃষ্ঠা–৩৭, শ্যামসুন্দর–শেফালী ঘোষ স্মারকগ্রন্থ)
সৈয়দ মহিউদ্দিনের মতে, ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ হলো সেই গান সারা দেশের মানুষের কাছে বোধগম্য করার জন্য যে গানে প্রমিত বাংলা বা ভিন্ন অঞ্চলের শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া হতো।
শ্যাম–শেফালীর পর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কালজয়ী জুটি সঞ্জিত আচার্য্য ও কল্যাণী ঘোষ। অতি সম্প্রতি আমি এই দুই শিল্পীর সাথে কথা বলেছি। তাঁরা দুজনই ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ এর সংজ্ঞায়নে সৈয়দ মহিউদ্দিনকে সমর্থন করেন।
এখানে বলা দরকার, আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী গীতিকাররাও সচেতনভাবে তাদের গানে কিছু প্রমিত বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন, সুর–ছন্দ, তাল–লয় ও ভাবের প্রয়োজনে, এটা দোষণীয় নয়। যেমন আস্কর আলী পণ্ডিতের একটি গান ‘তোরে হনে দিল চম্পা ফুল রে সন্ধ্যাবেলা’। এখানে ‘সন্ধ্যাবেলা’ চট্টগ্রামী ভাষার শব্দ নয়, গীতিকার সচেতনভাবে ‘আজিন্যা’ (সন্ধ্যা) কথাটা এড়িয়ে ‘সন্ধ্যাবেলা’ লিখেছেন শ্রুতিমধুরতার জন্য। কিন্তু ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ হলো সেই গান, যে গান শুনলে মনে হবে ‘বকের বাসায় কাকের ছা’–গানগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য অশ্লীলতা। এগুলোর রচয়িতা মূলত বাজারি গীতিকাররা। এই রকম গান অতীতে ক্যাসেটে ছিল, এখন আছে ইউটিউব, ফেসবুকে। আমার আপত্তি এটাই যে, কানু শাহ, আস্কর আলী পণ্ডিত, রমেশ শীল বা গফুর হালীর মতো কিংবদন্তীদের গানকে কেন ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ বলা হবে? কারণ উনারাই তো চাটগাঁইয়া গানের প্রধানতম রূপকার।
কানু শাহ বা আস্কর আলী কি আঞ্চলিক গান লিখেছেন :
শামসুল আরেফিন লিখেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে পুঁথি রচনার একটি রীতি লক্ষণীয়। ঊনিশ–বিশ শতকে আস্কর আলী পণ্ডিত রচিত পুঁথিতেও এই রীতি লক্ষ্যগোচর হয়। আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকির এই রীতি অনুসরণ করে অর্থাৎ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ প্রয়োগ করে গান লিখেছিলেন। আস্কর আলী পণ্ডিতের গানেও এই রীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। একসময় এ ধরনের গানকে চট্টগ্রামে কাউয়া আঞ্চলিক গান বলা হতো।’
মধ্যযুগের কবি আলী রজা ওরফে কানু শাহ’র সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ হলো ‘জ্ঞানসাগর’, যা পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্য ভুবনে আনোয়ারা মোকামের ওষখাইন গ্রামের কবি আলী রজার আবিষ্কারক হলেন মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। আজ থেকে ১০৭ বছর আগে ১৯১৭ সালে (বাংলা ১৩২৪) আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় ‘কলকতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে আলী রজার কাব্যগ্রন্থ ‘জ্ঞানসাগর’ প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যবিশারদ কানু ফকিরের ছয়টি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘জ্ঞানসাগর’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থের নাম ‘‘জ্ঞানসাগর’’। …ইহা একখানি দরবেশী গ্রন্থ। ইহার প্রায় আদ্যোপান্ত নিগুঢ় আধ্যাত্মিক কথায় পূর্ণ। সে আধ্যাত্মিকতায় আবার হিন্দু–মুসলমানী ভাবের সংমিশ্রণ দেখা যায়।’
বস্তুত কানু শাহ কোন আঞ্চলিক গান লিখেননি, তার কাব্যে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ থাকতে পারে। তেমনি আস্কর আলী পণ্ডিতও কোন আঞ্চলিক গান লিখেননি। মূলত তিনি প্রাচীন বাংলা গানের ধারায় লোকগীতি লিখেছেন, যেখানে আঞ্চলিক ভাষার শব্দ প্রয়োগের মুন্সিয়ানা রয়েছে। আর আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ থাকলেই তো তাকে ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ বলা যায় না। চর্যাপদ, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ এমনকি মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের কাব্যেও আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণ আছে। যেমন কবি আবদুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় লিখেছেন ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয়ন জানি‘। এখানে ‘ন জানি’ হলো চট্টগ্রামী ভাষার শব্দ। কবি ছিলেন সন্দ্বীপের বাসিন্দা। এখন আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে বলে কি এই কবিতাকে ‘কাউয়া কবিতা’ বলা হবে?
কাউয়া আঞ্চলিক গানের উদাহারণ :
আবদুল গফুর হালীর একটি আইকনিক গান হলো বানু রে জি জি জি …। এই গানটি সত্তরের দশকে গ্রামোফোন রেকর্ডে শ্যাম–শেফালীর কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয় হয়। গানটির মূল ভার্সন এমন…
ছেলে : বানু রে
মেয়ে : জি
ছেলে : অ বানু
মেয়ে : জি জি জি
রেঙ্গুম শঅরত যাইয়ুম আঁই তোয়াল্লাই আইন্নুম কি
মেয়ে : শাড়িচূড়ির আশা গরি রেঙ্গুম যাইতাম দি যদি
সোনার যৈবন কেনে রাইখ্যুম গামছা দি বাঁধি।
ছেলে : অক্কল সমত তোঁয়ার কথা মনত থাকিব
মেয়ে : চাইও তোঁয়ারে বার্মার মাইয়া ফাঁদত ফেলাইব
ছেলে : বার্মার মাইয়া কি গরিব আঁই যদি ঠিক থাকি।।
এই গানটি সত্তরের দশকে মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে গেয়েছিলেন শ্যাম–শেফালী, সংগীত পরিচালনায় ছিলেন বশির আহমেদ। সেখানে কিন্তু গানের পরতে–পরতে ঢুকে পড়েছে প্রমিত ও অন্য অঞ্চলের শব্দ। সেই গানটি এমন…
ছেলে : বানু রে
মেয়ে : জি
ছেলে : অ বানু
মেয়ে : জি জি জি
ছেলে : ঢাকা শহর যামু আমি তোয়াল্লাই আনুম কি
মেয়ে : শাড়িচুড়ির আশা করি রেঙ্গুম যাইবার দি যদি
সোনার যৈবন কেমনে রাখুম গামছা দি বাঁধি।।
ছেলে : সকল সময় তোঁয়ার কথা মনে থাকিব
মেয়ে : চাইও তোঁয়ারে ঢাকার মাইয়াই ফাঁদে ফেলাইব
ছেলে : ঢাকার মাইয়া কি করিব আমি যদি ঠিক থাকি।।
সহজেই অনুমেয় চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানটি বিকৃত করা হয়েছে। গীতিকারের অজান্তে এই কাজটি করা হতো। এই গানে প্রমিত বাংলা ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক শব্দ ‘যামু, আনুম, কেমনে, করিব’ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এম এন আখতার কথিত ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক গান’ :
আরেফীন সাহেব ‘কাওয়া আঞ্চলিক’ গানের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য কিংবদন্তী সংগীতজ্ঞ এম এন আখতারের বক্তব্যকে স্বাক্ষী মেনেছেন। এম এন আখতার তাঁর ‘মানবদরদী সুরসাধক’ গ্রন্থে ‘আমার কালুরঘাট বেতার’ শীর্ষক ভূমিকায় ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক গান’ বিষয়ে বলেছেন, ‘একসময় আঞ্চলিক গানকে মানুষ ঘৃণা করত, আঞ্চলিক গানের শিল্পীদের নাজেহাল করত।’ কিন্তু সেটা কোন আঞ্চলিক গান? এম এন আখতার তার লেখার শিরোনামই তো করেছেন ‘অম্লীল কাউয়া আঞ্চলিক’ গান। অর্থাৎ কাউয়া আঞ্চলিক গানের সাথে অশ্লীতার সম্পর্ক ওতোপ্রোত। কবিয়াল রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাছির, আবদুল গফুর হালীরা ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক গান’ কখন লিখেছেন? কোথায় আছে সে গান?
প্রসঙ্গত, এম এন আখতার তার লেখায় ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ এর কোন সংজ্ঞা দেননি, এই গানের কোন উদাহারণও দেননি, এই গানের রচয়িতা হিসাবে কারও নামও উল্লেখ করেননি । আরেফীন সাহেব কেন জানি এম এন আখতারের লেখা থেকে ‘অশ্লীল’ শব্দ বাদ দিয়েছেন। এমনকি আরেফীন তাঁর লেখায় এম এন আখতারের ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ তত্ত্ব ব্যবহার করে এই গানের রচয়িতাদের কাতারে ফেলেছেন খোদ এম এন আখতারকেও। (দ্রষ্টব্য : দৈনিক আজাদী)
মজার বিষয় হলো, ‘মানবদরদী সুরসাধক’ গ্রন্থের লেখায় এম এন আখতার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকেও ‘অপসংস্কৃতি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, এও বলেছেন, তিনি নিজের অজান্তেই এই ‘অপসংস্কৃতি’তে ঢুকে পড়েছেন। এখন এম এন আখতারের ‘কাউয়া আঞ্চলিক তত্ত্ব’ মেনে নিলে তিনি যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকেও ‘অপসংস্কৃতি’ বলেছেন, সেটাও মেনে নিতে হয়, আরেফীন সাহেব কি এটাও সমর্থন করেন? এম এন আখতার কিন্তু তার লেখায় এটাও বলেছেন, ‘অর্থাৎ সে সময় যেকোন আঞ্চলিক গান বলতেই অপসংস্কৃতি ও অশ্লীল’ ভাবা হতো।
প্রসঙ্গত, আঞ্চলিক নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে হেনস্থা হয়েছিলেন এম এন আখতার। বলা হয়েছিল আঞ্চলিক নাটকে অশ্লীলতা আছে। তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই। ১৯৭৭ সালের ১ জুলাই হাসনাত সাহেব ‘চুড়িওয়ালা’ নাটক সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গীতিনাট্য ‘চুড়িওয়ালা’ প্রকাশভঙ্গিতে সহজ ও সরল কিন্তু এর আবেদন মানুষের মনের গভীরে। কেননা ‘চুড়িওয়ালা’ সাধারণ মানুষের প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসার জয়গানে মুখরিত। এইসব শ্বাশ্বত মানবিক অনুভূতির আবেদন দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বকালের মানুষের কাছে সমান।’ (সূত্র : মানবদরদী সুরনাধক, এম এন আখতার)।
পরে অবশ্য প্রতিবাদকারীর দল পিছু হটেছিল এবং চট্টগ্রামের মুসলিম হল ও আগ্রাবাদ স্কুলে ‘চুড়িওয়ালা’ নাটক দেখার জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল।
আস্কর আলীর লোকসংগীত আদি রসাত্মক, অশ্লীলতাযুক্ত?
শামসুল আরেফীন কাউয়া আঞ্চলিক গান সম্পর্কে আরও লিখেছেন, ‘শুদ্ধ বাংলার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে রচিত গানকে কাউয়া আঞ্চলিক গান বলা হতো কেন, তার সঠিক কারণসমূহ আমাদের জানা নেই। তবে ধারণা করতে পারি, প্রাগুক্ত আদিরসাত্মক এবং বিকৃতি রুচি ও অশ্লীলতাযুক্ত গানগুলোই ছিল মূল কারণ। ‘কাউয়া’ শব্দ থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের গানকে এই শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে চরম উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অসম্মানিত করা হতো। তবে সাধারণ মানুষ বা লোকসমাজের কাছে এই গানগুলোর চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ছিল। আস্কর আলী পণ্ডিতের সময়ে তার জনপ্রিয় হওয়া এ ধরনের কিছু গান : ‘কী জ্বালা দি গেলা মোরে’, ‘ডালেত লরি চরি বৈও চাতকি ময়না’, ‘বসি রইলি ও মন কার আশে/রঙ্গের বাজার।’ (চট্টগ্রামের কাউয়া আঞ্চলিক গান, দৈনিক ভোরের কাগজ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪)।
‘আস্কর আলী পণ্ডিত’ গবেষণায় শামসুল আরেফীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর ‘আস্কর আলী পণ্ডিত : একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ একটি মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ। কিন্তু সেই তিনি কীভাবে আস্কর আলী পণ্ডিতের লোকসংগীতকে আদি রসাত্মক, বিকৃত রুচির ও অশ্লীলতাযুক্ত’ হিসাবে বর্ণনা করলেন তা আমার বোধগম্য নয়। আস্কর আলীর ‘ডালেতে লরিচরি বইও’ গানটি ভাবসংগীত, এই গানের মূল ভাব হলো নর–নারীর প্রেম আর অধ্যাত্মিকতা। মধ্যযুগের কবি আলী রজা ওরফে কানু শাহ বলেছেন, ‘গীতন্ত্র মহামন্ত্র বৈরাগীর কাম/তালযন্ত্র মহামন্ত্র প্রভুর নিজ নাম’। আলী রজার ভাবের উত্তরসূরী আস্কর আলী পণ্ডিতও গেয়েছেন একই ভাবধারায়…
ডালেত লরি চরি বৈও চাতকি ময়না,
গাইলে বৈরাগির গিত গাইও॥ ধুয়া॥
অরে চাতকি ময়না রঙ্গ তোর কালা।
তোমার মনে আমার মনে এক প্রেম জ্বালা॥
আচ্ছা, এখানে আদিরসাত্মক, অশ্লীল বা বিকৃত রুচির কী আছে? আস্কর আলী পণ্ডিতের আরো দুটি গানকে ‘অশ্লীল’ কাউয়া আঞ্চলিক গানের কাতারে ফেলেছেন শামসুল আরেফীন। সেগুলো হলো, ‘কি জ্বালা দি গেলা মোরে’, ও ‘বসে রইলি মন কার আশে…’। আমি নিচে ‘বসে রইলি মন কার আশে’ গানটির পূর্ণ রূপ তুলে ধরছি।
বসে রইলি মন কার আশে
রঙের বাজার ভাঙ্গি যাইব একদিন চোখের নিমিষে।
তেল থাকিতে বাত্তিরে নিভে কাল তুফানের বাতাসে।।
গুরু কেমন ধনরে ও ভাই, গুরু কেমন ধন
সময় থাকতে না চিনিলি ওরে অবুঝ মন।
ভবের খেলা বিষম জ্বালা দুধের সনে বিষ মিশে।।
বাণিজ্যে পাঠাইল তোরে বহু ধন দি
লাভেমূলে সব হারালি সঙ্গে নিবি কি।
তোরে গেরেফতারি গরি নিব লুকাই থাকবি কার পাশে।।
গুরু পদ ধরি হীন আস্কর আলী কয়
সময়ে না করলে সাধন অসময় কি হয়।
নাইয়রত্তুন নাস্তা আইনলে স্বামিয়ে ভালবাসে।।
এই গানটির ভাব তো খুব সহজ…একদিন রঙের বাজার তথা এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি পরপারের পূজি না থাকে তাহলে তুমি স্রষ্টার সামনে কী নিয়ে দাঁড়াবে? যেদিন সমন আসবে, গ্রেপ্তার অনিবার্য সেদিন কার পাশে লুকিয়ে থাকবে? তাই অনেকটা লালনের মতোই আস্কর আলী বলেছেন, ‘সময়ে না করলে সাধন অসময় কি হয়’। নাইয়র থেকে নাস্তা আনলে যেমন স্বামী খুশি হয় তেমনি ইহকাল থেকে পূণ্য নিয়ে গেলে পরকালে পরম স্বামী খুশি হবেন।
আচ্ছা, বলুন এই গানকে কাউয়া আঞ্চলিক বলার যুক্তিটা কী? শামসুল আরেফীন কাউয়া আঞ্চলিক গানের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, ওই যে আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণ, আদি রস, অশ্লীলতা… এই গানে তার কোনটা আছে? আর আস্কর আলী পণ্ডিত একজন দরবেশ কবি। তাঁর গানে আদি রস খোঁজা দুঃখজনক।
সবেশেষ বলি, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের লিজেন্ড আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার, শেফালী ঘোষ, সঞ্জিত আচার্য, কল্যাণী ঘোষ, সৈয়দ মহিউদ্দিন কিংবা বুলবুল আকতারের পরম স্নেহ পেয়েছি আমি। প্রায় দুই যুগ ধরে তাঁদের সংগীত জীবন অনুধাবনে আমার বিশ্বাস হয়েছে, চট্টগ্রামে ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ বা ‘হালদাফাডা গান’ শব্দগুলো ক্ষেত্রবিশেষে গালি। এইসব শব্দবন্ধের অনুচিত ব্যবহার শিল্পী ও তাঁদের পরিজনদের কষ্ট দেয়। একজন গবেষকের কাছ থেকে তা অপ্রত্যাশিত।
নাসির উদ্দিন হায়দার, সাংবাদিক ও চট্টগ্রামের লোকসংগীত গবেষক