গত ৫ অক্টোবর ২০২৩ আমরা হারিয়েছি আমাদের দেশের বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরীকে। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলা কবিতার আসাদ চৌধুরী অধ্যায়। তিনি ছিলেন এমন এক কবি, যিনি রাজধানীতে বসে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কবি–প্রতিভাকে অন্বেষণ করে গেছেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় শোনা যেতো তরুণদের স্পর্ধিত উচ্চারণ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজকের এই লেখা।
আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩–২০২৩) আমাদের দেশের শক্তিশালী ও জনপ্রিয় এক কবি। পংক্তি নির্মাণে, চিত্রকল্পে, উপমায়, উপস্থাপনায় আমরা দেখেছি তাঁর আশ্চর্যরকম ক্ষমতা। বাক্যের সরলতা ও বক্তব্যের বলিষ্ঠতা তাঁর কবিতাকে গতিময় করে রাখে। অকুণ্ঠ মেধার অধিকারী এই কবি স্বপ্নের কথা বলেছেন, বলেছেন সম্ভাবনার কথা এবং জীবনের আলোকময় দিকের কথা। ‘তবক দেওয়া পান’ (১৯৭৫) গ্রন্থ দিয়ে প্রথম আলোড়ন তুলেছিলেন কাব্যভুবনে। এর পর আমরা পাই ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’ (১৯৭৬); ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’ (১৯৭৬); ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’ (১৯৮২); ‘যে পারে পারুক’ (১৯৮৩); ‘মধ্য মাঠ থেকে’ (১৯৮৪); ‘মেঘের জুলুম পাখির জুলুম’ (১৯৮৫); ‘আমার কবিতা’ (১৯৮৫); ‘ভালোবাসার কবিতা’ (১৯৮৫); ‘প্রেমের কবিতা’ (১৯৮৫); ‘দুঃখীরা গল্প করে’ (১৯৮৭); ‘নদীও বিবস্ত্র হয়’ (১৯৯২); ‘টান ভালোবাসার কবিতা’ (১৯৯৭); ‘বাতাস যেমন পরিচিত’ (১৯৯৮); ‘বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই’ (১৯৯৮); ‘কবিতা–সমগ্র’ (২০০২); ‘কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি’ (২০০৩); ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ (২০০৬) প্রভৃতি।
কবিতায় তিনি যতটা সংযত ও স্বল্পবাক; বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ততটা অকুণ্ঠ ও নির্ভীক। ষাট দশকের কবি আসাদ চৌধুরী ষাট বছর ধরে কবিতার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যকে অবলোকন করেছেন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। আঙ্গিকে, বক্তব্য বিন্যাসে এবং কাব্যরীতিতে পরীক্ষা নিরীক্ষা যেমন করেছেন, তেমনি কাব্যভাষা তৈরি করে মৌলিক স্বতন্ত্র কবি হিসেবে নিজেকে সমৃদ্ধ ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর বর্ণিল, চিত্রল, অলঙ্কারসমৃদ্ধ পংক্তিগুলি যেন কবিতার বড় এক সাধকের চেহারাকে তুলে ধরে; যিনি এক মহীরূহ। কবিতা বিষয়ে আসাদ চৌধুরীর অনুভব ও মূল্যায়নও চমৎকার। তিনি বলেছেন, একজন কবি যখন লেখালেখি করেন সেখানে তার চিন্তা তার সৃজনশীলতা এসবের বাহন হচ্ছে কবিতা। সমকালীন কাব্যভাষায় সমকালীন পরিবেশে যিনি যখন লেখেন তখন তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকে লেখেন। বা তার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে তিনি সেটা নিয়ে লেখেন। এর ফলে হয় কী তার ব্যক্তিগত অনুরাগ অনুভূতি যখন শিল্পরূপ পায় তখন কিন্তু এটা সম্মোহনিক অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়। পরাধীন ভারতে বিদ্রোহী কবিতা রচনা সম্ভব হয়েছে। এবং বিদ্রোহী কবি বললেই এক নজরুল ইসলামকেই মনে করি। তার বয়স তখন কত? কিন্তু তিনি অনুভব করেছিলেন যে মানুষের ভেতর প্রচুর সম্ভাবনা আছে। তিনি সেই সময়ের প্রতিটি মানুষের ইচ্ছে বাসনাকে এক ‘আমি’র মধ্যে ধারণ করেছিলেন। এখন এই আমি আরো বেশি সর্বপ্লাবী হতে পারে। … কবির সবচাইতে বড় দায়িত্ব হচ্ছে জাতি যখন দুঃস্বপ্নে নুইয়ে পড়ে কবি তখন স্বপ্ন দেখান। স্বপ্ন সে দেখে না শুধু দেখায়। এটি কোনো অত্যাচারী শাসক কখনোই পছন্দ করবে না। র্যাবো যেমন বোদলেয়ার সম্পর্কে বলেছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্নের দেবতা। স্বপ্ন দেখার বা দেখানোর ব্যাপারটা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার।
২.
কবিতার বিনয়ী বৃক্ষ আসাদ চৌধুরী বড়দের পাশাপাশি ছোটোদের জন্যও উপহার দিয়েছেন চমৎকার কিছু রচনা। ছড়া, কিশোরকবিতা, গল্প, রূপকথা, জীবনী ও বিদেশি গল্পের অনুবাদ। প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : রাজার নতুন জামা (রূপান্তর, ১৯৭৯); রাজা বাদশার গল্প (১৯৮০); গ্রাম বাংলার গল্প (১৯৮০); ছোট্ট রাজপুত্র (অনুবাদ : ১৯৮২); গর্ব আমার অনেক কিছুর (১৯৯৬); ভিন দেশের মজার লোককাহিনী (১৯৯৯); তিন রসরাজের আড্ডা (১৯৯৯); কেশবতী রাজকন্যা (২০০০); গ্রাম বাংলা আরো গল্প (২০০০); তোমাদের প্রিয় চার শিল্পী (জীবনী, ২০০০); জন হেনরি (আমেরিকার লোককাহিনী, ২০০১); মিকালেঞ্জেনো (জীবনী, ২০০১); ছোটদের মজার গল্প (২০০১); সোনার খড়ম (২০০৬); মুচি–ভূ’তের গল্প (২০০৬); সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু (১৯৮৩); রজনীকান্ত সেন (১৯৮৯); স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী (২০০১); ইতিহাস : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৩)।
তাঁর শিশুসাহিত্য এক কথায় চমৎকার। তাঁর শিশুসাহিত্য রচনা বিষয়ে তিনি নিজে বলেছেন, ‘শিশুসাহিত্য সাহিত্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। শিশুদের জন্য যদি আমরা ভালো বই লিখতে না পারি। বা ভালো অনুবাদ যদি তাদের হাতে তুলে দিতে না পারি তাহলে আজকে যে আমরা বলছি পাঠক নেই পাঠক নেই, তবে পাঠক তৈরি হবে কেমন করে। দেখা যাবে যে সমস্ত দেশে সাহিত্যের পাঠকদের নিয়ে গর্ব করে। মানে অনেক পাঠক বই পড়ে। সেসব দেশে শিশুসাহিত্যও তত উন্নত। এমনকি কলকাতার কথাই যদি ধরি। কত রকমের শিশুদের পত্রিকা ও প্রকাশনা। এজন্য ওখানে পাঠকও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও একজন লেখক নিজেই পাঠক তৈরি করবেন। তাঁর নিজের পাঠক নিজেই তৈরি করবেন। সে ক্ষেত্রে শিশুসাহিত্যের বিকল্প নেই। পত্রপত্রিকা প্রকাশনা তো বটেই ওরা তো পাঠক তৈরির চেষ্টা করবেই। একজন লেখককে তাঁর নিজের পাঠক নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। এই আমাদের দেশে চাই বা না চাই মাঝে মাঝে যে মৌলবাদের হুঙ্কার হয়। সমাজে নানা ধরনের শিশুকিশোর অপরাধ হয়। এর প্রধান কারণ উপেক্ষিত শিশুসাহিত্য। এটা সত্য কথা যে এ ক্ষেত্রে মানে শিশুসাহিত্যে আমাদের দুর্বলতা আছে। … আমি যে কারণে বিজ্ঞানীদের নিয়ে লিখেছি, আমি যে কারণে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে লিখেছি শিশুতোষ লেখা এটা একটা দায়িত্ববোধ থেকে লেখা। শিশুসাহিত্য নিয়ে আরো কিছু লেখার প্ল্যান আছে আমার।’ কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁকে হারিয়ে আমরা তাঁর নতুন লেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।
৩.
আসাদ চৌধুরী ছিলেন একজন দায়িত্বশীল লেখক। সমাজের প্রতি, সমাজের মানুষের প্রতি, ছোটোদের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ। ফলে বিজ্ঞান, ইতিহাস ও মনীষীদের জীবনী লিখে তাঁর দায় মেটানোর প্রয়াস আমরা লক্ষ করি। সৃজনশীল রচনায় অত্যন্ত দক্ষ এই কবি ছড়া ও কবিতা দিয়ে পাঠকের মনকে রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন। বলায় চলায় লেখায় উপস্থাপনায় তিনি ছিলেন অনন্য। সবসময় হাসিখুশি, সবসময় প্রাণবন্ত ছিলেন তিনি। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটি নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই মিশে গেছে তাঁর।
আসাদ চৌধুরীর ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ কবিতাটি আবৃত্তির কারণে অনেক জনপ্রিয় একটি কবিতা।
নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিল গানের সুরে
আগুন ছিল কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিল
এ কথা কে ভাববে?
কুকুর–বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোঁসে সাপের ফণা
শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।
আগুন ছিল মুক্তিসেনার
স্বপ্ন–ঢলের বন্যায়–
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিল সব অন্যায়।
এখন এসব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।
এই কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ চিত্রকে তুলে ধরে। মহান একাত্তরের বাঙালির এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়কে চিত্রায়িত করেছেন কবি এ কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনের স্মৃতি এ কাব্যের পরতে পরতে সাজানো রয়েছে। একই সাথে রয়েছে স্বপ্ন ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম–এখন আছি অল্প’ এ বাক্যে কবি সমকালের অবক্ষয়কে আঘাত করেছেন সমান ভাবে।
তাঁর আরেকটি কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ছন্দে, বক্তব্যে, উপমায়, বিন্যাসে অনন্য কবিতা সেটি।
ট্রেন যায় হিশ হিশ
বায়ু যায় ফিশ ফিশ
চোর যায় চুপ চাপ
ট্রাক যায় ধুপ ধাপ
গরিবের দিন যায়
কী করে
কী করে
কী করে,
জানবার সাধ হলে হাত দাও
শিকড়ে
শিকড়ে
শিকড়ে।
কবিতাটি পড়ার পর বুকটা হু হু করে ওঠে। গরিবের দিন কীভাবে যায় জানতে হলে শিকড়ে অর্থাৎ গভীরে পৌঁছাতে হবে। অসাধারণ। কবিতার বক্তব্যের রেশ যেন শেষ হয় না। আরো কিছু বলতে চায় কবিতা।
অনেক রক্ত ঢেলে, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের প্রিয় দেশ ‘বাংলাদেশ’। যেই আশায় আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেই আশা কি আমাদের পূর্ণ হয়েছে? আমরা কি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি? এই সব প্রশ্ন আমরা পাই আসাদ চৌধুরীর কবিতায়। ‘শহীদদের প্রতি’ তিনি বলেছেন :
তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল?
ঘৃণার ছিল?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কারনিসে কি ধুসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই দায়িত্ব পালনে যেন সচেষ্ট হন, তার আহ্বান আছে পরোক্ষভাবে।
‘জানাজানি’ কবি আসাদ চৌধুরীর আরেক চমৎকার কবিতা। বাংলাদেশে প্রকৃতি, বাংলা ভাষা, দেশপ্রেম একাকার হয়ে গেছে এই কবিতায়। পাঠক পড়ে অভিভূত হন তাঁর এই সব কবিতা। শুধু ছোটোরা নয়, বড়রাও তাঁর এই সব রচনার মুগ্ধ পাঠক। কবিতাটি এখানে তুলে ধরতে চাই :
বাংলাদেশের পাখি কেন মধুর সুরে ডাকে,
জানো?
বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে,
জানো?
জানি জানি জানি।
পাখির ভাষার মান দিতে যে
বাঙালি দেয় জান–
পাখি যে তা জানে,
তাইতো পাখি পাগল করে,
বিহান বেলার গানে।
বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে,
জানো?
জানি জানি জানি।
উদার আকাশ যে ইশারায়
ডাক দিয়ে যায় প্রাণে,
বাঙালি তা জানে।
তাইতো আকাশ টিপ এঁকে যায়
ললাটের মাঝখানে।
বাংলাদেশ, বাঙালি, বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের মানুষে মানুষে সম্পর্ক, সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি– এগুলো নিয়ে পড়তে বেশি ভালোবাসতেন আসাদ চৌধুরী, লিখতেও ভালোবাসতেন। তাঁর সকল রচনা যেমন শিল্পগুণে উত্তীর্ণ, তেমনি রসবোধে সমৃদ্ধ। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কাব্যব্যক্তিত্ব। তাঁর গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত কবিতাগুলি আমাদের পরম সম্পদ।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর :৪২২), বাংলা একাডেমি।