সাক্ষাৎ যমদূত যেন দরোজা থেকে ফিরে গেলেন। তার ভয়ে নির্ঘুম রাত জেগে থাকা তটস্থ মানুষের চোখে মুখে স্বস্তির আভাস। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ ছিল সেই যমদূত, যে লণ্ডভণ্ড করে দিত গ্রামের পর গ্রাম। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী মানুষ যেন ঘরপোড়া গরু। সেই ৭০ সাল থেকে বারে বারে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের উপর। তাই এবারো মোখা তাণ্ডব চালানোর আগে সহায়সম্বলহীন মানুষগুলো আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটে এসেছিল প্রাণ বাঁচাতে।
কারো কোলে আদরের সন্তান, কারো হাতে প্রিয় গবাদি প্রাণী, আবার কারো হাতে ঘটি–বাটি–বদনা, কেউবা নিয়েছে ঝাড়ু, কারো কারো হাতে আছে কাপড়ের ব্যাগ, হাতপাখা, কারো হাতে কাঠের ছাতা। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র।
আর গতকাল মোখার প্রস্থানের খবরে তারা ফিরে আসছিল আনন্দে উদ্বেল হয়ে। প্রত্যেকের কণ্ঠে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। কেউ বলছেন, ‘বান্দার লাই আল্লার পরান কাঁদে। মোখাইয়া আইসতু চাইয়েরেও ন আয়ুনর কারণ আর কিছু ন।’ আবার কেউ বলছেন, ‘ভগবান দেহাই দিইয়ে, মারিত ফারে, আবার বাচনর মালিকও তাঁই’। ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার ছয়টি উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ শনিবার রাতের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করেছিল।
বাংলাদেশে ইতোপূর্বে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে। প্রকৃতির রুদ্রতার সামনে ভেসে গেছে মানুষের প্রতিরোধের সকল চেষ্টা। এবার মিডিয়ার কল্যাণে মোখার আগমন নিয়ে সপ্তাহকাল ধরেই চলেছে জোর আলোচনা। সরকারি বেসরকারিভাবে দুর্গত অঞ্চলের মানুষকে রক্ষায় নেয়া হয়েছিল নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। তারা জানেন ফিরে এসে ঘরের আসবাব দূরের কথা, মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকুও খুঁজে পাবেন না। বিপদ কেটে গেছে জেনে তারা রুদ্ধশ্বাসে ছুটছেন আপনালয়ের দিকে। আবার অনেকের চোখে অবিশ্বাস খেলা করছে। কারণ প্রকৃতি এত সহজেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার চিহ্ন তারা জীবদ্দশায় খুব কমই দেখেছেন! নাজিরপাড়া থেকে রিক্সাচালক কবিরের চার বছরের ছেলে আরিফ মা বাবার সাথে পতেঙ্গায় আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছিল। গতকাল ছুটছে সে মা বাবার আগে আগে। হাতে ধরা প্রিয় ছাগলটার দড়ি। কবির ও তার স্ত্রী নিয়ে এসেছিলেন তাদের আদরের ধন আরিফকে। আর আরিফের প্রিয় তার ছাগলটা।
সোনাবালা জলদাস (৫০) তার চলাফেরায় প্রায় অক্ষম অসুস্থ স্বামীকে কাঁধে ভর দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন ঘরে। হাঁটছিলেন তিনি মন্থর গতিতে। বললেন, ‘পোয়ার বাপ অ বাজি হাডিত চলিত ন পারে। তারপরও তারে ফেলাই সেন্টারত যাইতু মন ন চায়। লুলা মানুষ্যারে ক্যানে ফেলাই যাইয়ুম?’ মোখার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচার কারণ তিনি মনে করেন ‘ভগবান চাইয়ি’ বলেই।
একই এলাকার আজগর আলী কাল বিকেলে ঘরে ফিরছিলেন রাগে গজগজ করতে করতে। কারণ কোলে নিয়েছেন বাচ্চাকে। অন্য হাতে কাপড়ের ব্যাগ ও ছয়টি ছাগলের দড়ি। অন্য কোন মালামাল না নেয়া প্রসঙ্গে বলেন, ছাগলগুলোর উপর মায়া পড়ে গেছে। তাই কোলের বাচ্চাটির মতো অবলা জীবগুলোকে বাঁচানোও ফরজ কাজ বলে মনে করেছিলেন তিনি।
অনেকেই প্রিয় সন্তানদের নিয়েই ছুটে গিয়েছিলেন আশ্রয় কেন্দ্রে। ঘরের জিনিসপত্র আর পাবেন না ধরে নিয়েই তারা ঘর ছেড়েছিলেন। কাল যখন ফিরে যাচ্ছেন, তখন তাদের চোখে মুখে অপ্রত্যাশিত আনন্দ। কিছুই হারায় নি, সবকিছুই আছে আগের মতো– এ আনন্দ ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের গত দুইদিনের নির্ঘুম রাত কাটানোর কষ্ট।
জানা গেছে, জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের অধিকাংশই ঠাঁই নিয়েছিলেন নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রে। আবার অনেকে চলে গিয়েছিলেন ঝুঁকি নেই এমন স্থানে আত্মীয়–স্বজনের বাড়িতে।
পতেঙ্গা বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা চা দোকানি মো. খলিলও চিন্তিত, এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার সংবাদটি। নিজের ছোট্ট দোকানটাতে এসে তাই নিজেই চায়ের কাপগুলো সাজাতে লাগলেন নতুন করে জীবন শুরুর তাগিদে।
পতেঙ্গা ১৫ নম্বর এলাকার মো. ইলিয়াস ও মো. এমরান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন বারে বারে। তারা বলেন, মোখা আঘাত হানলে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হতো। এজন্য পরিবারের সদস্যদের স্থানীয় পোড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইক্লোন শেল্টারে পাঠিয়েছিলেন। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ায় বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানালেন।
দক্ষিণ পতেঙ্গার লালদিয়ার চর এলাকার বাসিন্দা আক্তার হোসেন, নূর আলী ও শামসুল আলম দোকানের ফ্রিজ, আলমিরাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ফিরিয়ে নিয়ে চলেছেন নিজ নিজ দোকানে। তাদের চোখেও অবিশ্বাসের ছায়া। আক্তার বলেন, ভাই এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, এত দপাদপির পর এত অল্প সময়ে আবার দোকান করতে পারবো।
গতকাল বিকেলে পতেঙ্গা এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেকেই ঘরের আসবাবপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন নিজ নিজ ঘরে।
জানা গেছে দুর্গত মানুষের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছিল। এছাড়া কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত সকল স্কুল–কলেজকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এর বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দোতলা বা তার চেয়ে উঁচু সকল সরকারী–বেসরকারী অফিসসহ সব ধরনের ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।