আজ ১০ মুহররম বুধবার পবিত্র আশুরা। প্রাচীনকাল থেকেই এ দিবসটি অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে। দশ মুহররমকে বলা হয় আশুরা। ৬১ হিজরির ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ১০ মুহররম এই আশুরার দিনে বিশ্বমানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নিদারুণ মর্মান্তিক ও বিয়োগান্ত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে। এরপর থেকেই এ দিবসটি বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত। আজকের এ দিনে মানবজাতির ইতিহাসে বহু অলৌকিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহপাক আসমান–জমিন, লওহ–কলম, সাগর–পর্বত সৃষ্টি করেছেন। হজরত আদম (আ.)-এর জন্ম, দুনিয়াতে অবতরণ, গুনাহ মাফ, জান্নাতে প্রবেশ, হজরত হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টি, জান্নাত সৃষ্টি, হজরত নুহ (আ.)-এর কিশতি জুদী পাহাড়ের পাদদেশে স্থির, হজরত ইবরাহিম (আ.) খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিতকরণ, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্ম ও অগ্নিকুণ্ড থেকে নাজাত, হজরত দাউদ (আ.)-এর তাওবা কবুল, হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে উদ্ধার, হজরত মুসা (আ.)-এর লোহিত সাগর পার, ফেরাউন ও তার দলবলসহ লোহিত সাগরে নিমজ্জিত, হজরত আইয়ুব (আ.) তাঁর কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য, হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও আসমানে তুলে নেয়া, চল্লিশ বছর পর হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত লাভ ও হজরত হুসাইন (রা.) করবালা প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন এই আশুরার দিনে। বর্ণিত আছে, কিয়ামতও এ আশুরার দিনে সংঘটিত হবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তখন রাসুল (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন– এদিনে তোমরা রোজা রাখছো এর কারণ কি? তখন তারা বললো– এটি একটি মহান দিবস। এদিনে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) ও তাঁর কওমকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরাউন ও তার সম্প্রদায়কে নিমজ্জিত করেছেন। সুতরাং এর শুকরিয়া স্বরূপ মুসা (আ.) এ দিনে রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এদিনে রোজা রাখি। রাসুল (সা.) তা শুনে বললেন– ‘ফাআনা আহাক্কু বিমুসা মিনকুম।’ অর্থাৎ মুসার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে আরও নিবিঢ়। এরপর রাসুল (সা.) আশুরার দিনে নিজেও রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। -(সহিহুল বুখারি, হাদিস নং– ২০০৪)
হজরত আবু কাতাদাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন-‘আশুরার দিনের রোজার দ্বারা আমি আল্লাহ্র নিকট বিগত বছরের গুনাহ মাফের আশা রাখি।’ -(সুনান ইব্ন মাজাহ, হাদিস নং–১৭৩৮) হজরত হাফসা বিন্ত ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) চারটি জিনিস ত্যাগ করেননি। তা হচ্ছে– আশুরার রোজা। জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিনের রোজা, প্রতি চাঁদের ১৩, ১৪, ও ১৫ তারিখের রোজা এবং ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত। -(মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং– ২৬৪৫৯)
আশুরার পরিচয় দিতে গিয়ে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেছেন– ইয়াওমে আশুরা হচ্ছে এমন একটি দিন, জাহেলী যুুগে সেদিন কুরাইশরা রোজা রাখতো এবং রাসুল (সা.)ও রোজা রাখতেন। পরে তিনি মদিনায় থাকাকালে রোজা অব্যাহত রাখেন এবং লোকদের এ রোজা পালনের নির্দেশ দেন। -(সহিহুল বুখারি, হাদিস নং– ২০০২) হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন– ‘পবিত্র রমজান মাসের রোজার পরের স্থান মুহররম মাসের রোজা। আর ফরজ নামাজের পরের স্থান রাতের নফল নামাজ।’ -(সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং–২৪২৯)
হজরত আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের পর আশুরার রোজাকে যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন তা অন্য কোনো দিন বা মাসকে ততোটা গুরুত্ব দেননি। -(সহিহুল বুখারি, হাদিস নং– ২০০৬) হাদিসে আরও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি আশুরার রাতে খাঁটি অন্তরে নফল নামাজ আদায় করবে তার সকল গুনাহ আল্লাহপাক ক্ষমা করে দিবেন এবং তার ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হবে। যাবতীয় বিপদ–আপদ, রোগ–ব্যাধি ও দুঃখ–কষ্ট থেকে আল্লাহপাক তাকে মুক্ত রাখবেন। আর তার রুজি–রোজগারে বরকত ঢেলে দিবেন।’
আশুরার দিনে ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও গুরুত্বের সাথে রোজা পালন করে। তাই মুহররমের নয়, দশ এ দু’দিন রোজা রাখা অধিকতর উত্তম। কেননা রাসুল (সা.) আশা করেছিলেন পরের বছর বেঁচে থাকলে মুহররম মাসের দশম দিনের সাথে নবম দিনও সাওম পালন করবেন। -(সুনান ইব্ন মাজাহ, হাদিস নং– ১৭৩৬) তবে নয়, দশ অথবা দশ, একাদশ দু’দিন রোজা রাখলেও হবে। শুধু একদিন রোজা রাখা মাকরুহ। আশুরার রোজা মুসলিমদের জন্য প্রথমাবস্থায় ওয়াজিব ছিলো। হিজরি দ্বিতীয় সালে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হিসেবে বহাল রয়েছে। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রথমে আশুরার দিনে রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন যার ইচ্ছা (আশুরার) রোজা পালন করত। আর যার ইচ্ছা করত না। -(সহিহুল বুখারি, হাদিস নং– ২০০১)
১০ মহররম বিশ্বের ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলেও দিনটি মুসলিম উম্মাহর কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও হৃদয়বিদারক এবং বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকার কারণ হলো ন্যায় ও শান্তির দিশারী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদরের দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) অসত্য, অধর্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য, ধর্ম ও ন্যায়কে চির উন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নিজ জীবনকে উৎসর্গ করে শাহাদাতবরণ করেছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদিনের পর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র নেতা হলেন। রাজতন্ত্রের চিরাচরিত নিয়মানুসারে অনৈসলামিক উপায়ে আমিরে মুয়াবিয়া (রা.)-এর পুত্র ইয়াজিদ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন। কিন্তু হজরত হুসাইন (রা.) এই অন্যায় পছন্দ করেননি এবং বরদাশতও করেননি। সুতরাং এটাই ছিলো ইয়াজিদ ও হজরত হুসাইন (রা.)-এর মতভেদের মূল কারণ। ইতোমধ্যেই ইয়াজিদ কুফার গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইব্ন জিয়াদকে চিঠির মাধ্যমে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ইরাকের জমিনে হুসাইনকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দেন। কুফাবাসীর কাছ থেকে হুসাইন (রা.) প্রায় দেড়শটির মতো চিঠি পান। এসব চিঠিগুলোতে তাঁরা ইমাম হুসাইন (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছে এবং কুফায় ইমাম হুসাইন (রা.)-কে আগমনের আহ্বান জানিয়েছেন। তাই তাদের চিঠি মোতাবেক ইমাম হুসাইন (রা.) কুফায় রওয়ানা হলেন। কিন্তু পথিমধ্যেই উবাইদুল্লাহ ইব্ন জিয়াদের সৈন্যদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলেন। সৈন্যদেরকে তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়ে এবং ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহবান জানালেন। তিনি বললেন– আমাকে ইয়াজিদের কাছে যেতে দাও নতুবা মুসলিমদের কোনো সীমান্তে ফিরতে দাও অথবা মদিনায় ফিরে যেতে দাও। কিন্তু উবাইদুল্লাহ ইব্ন জিয়াদের বাহিনী ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কোনো প্রস্তাবই শুনলো না। তখন লড়াই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠলো।
৬১ হিজরি ১০ মুহররম কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে দু’দলের সৈন্যবাহিনী মুখোমুখি। একদল হচ্ছে, ইমাম হুসাইন (রা.)- এর এবং অন্যদল হচ্ছে উবাইদুল্লাহ ইব্ন জিয়াদের বাহিনী। ইমাম হুসাইন (রা.)- এর দলে সৈন্য সংখ্যা ছিলো অশ্বারোহী ৩২ জন এবং পদাতিক মাত্র ৪০ জন। উবাইদুল্লাহ ইব্ন জিয়াদের পক্ষে সৈন্য সংখ্যা ছিলো চার হাজার। প্রথম দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আমর বিন সা’দ, মুয়ায়রা। যুদ্ধ শুরু হলো। বাহিনীর সবাই বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে দুশমনের মোকাবেলায় একে একে শাহাদাতবরণ করনে। এরপর ইমাম হুসাইন (রা.) একাই জিহাদ করেন। অবশেষে কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করলেন ইমাম হুসাইন (রা.)।
হজরত হুসাইন (রা.)-এর এই শাহাদাতের মাধ্যমে বিশ্বে মানব জাতির জন্যে এক অনন্য, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করে গেছেন যে, মহান রাব্বুল আলামিন ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রেমে উদ্বুদ্ধ একজন মু’মিন প্রয়োজনে জীবন দিতে পারেন; কিন্তু একজন মু’মিন কোনো অবস্থাতেই আধিপত্যবাদ, অসত্য ও অন্যায়ের সামনে মাথা নত করতে পারেন না।
আশুরার শিক্ষা হলো– একজন মু’মিন মাথা নত করতে পারে শুধুমাত্র সকল সৃষ্টির স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে; অন্য কারো কাছে নয়। আশুরার দিবসে হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের, ফাসাদের বিরুদ্ধে আপোসের, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংযম ও মানবতার, অহংকারের বিরুদ্ধে বিনম্রতার, হিংস্রতার বিরুদ্ধে মহত্ববোধের, নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে হৃদ্যতার ও জবরদখলের বিরুদ্ধে অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং অশান্তির বিরুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন– ‘ফিরে এলো আজ সেই মুহররম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ আমরা আশুরার এ পবিত্র দিনে মাতম, মর্সিয়া, জারি, তাজিয়া মিছিল ইত্যাদি করে পবিত্র দিনটির পবিত্রতা নষ্ট না করি।
আসুন, আমরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে কারবালার সুমহান নীতি ও হজরত হুসাইন (রা.)-এর আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই এবং আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিফলন হোক। আর সমাজ থেকে অবিচার দ্বন্দ্ব–কলহ দূরীভূত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক– এটাই সবার কামনা।
লেখক : কলামিস্ট, গবেষক ও টিভি উপস্থাপক; প্রফেসর,
আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়