আশা নিরাশার দিনকাল

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৯:০৭ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি শিল্পকলা একাডেমির নিয়োগ প্রাপ্ত ডিজি সৈয়দ জামিল আহমেদের খণ্ডিত একটা উক্তি বেশ ঝড় তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যদিও তাঁর কথাগুলি সামপ্রতিক নয়। কোন এক সময় হয়তো বলেছিলেন। যেহেতু নারীর পোশাক নিয়ে কথা, যেহেতু ধর্ম নিয়ে কথা আর যায় কোথায়! এটাই তো মোক্ষম অস্ত্র! তাঁর বিরুদ্ধে এতো এতো পোস্ট, এতো এতো কমেন্টস পড়ে আমি রীতিমতো আতঙ্কিত! তিলকে তাল করার জাতি আমরা! এতো নেগেটিভ চিন্তা আমরা করতে পারি যা সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত না হলে কখনো জানতে পারতাম না! আমি ভদ্রলোকের জন্য দোয়া করি উনি যেন ঠিকঠাক থাকেন। এখন এমন একটা সময় আমরা পার করছি আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। এতো গুজব আর এতো মিথ্যার ছড়াছড়ি! কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা বুঝা দায়! তাঁর উদ্ধৃতিটি ছিল এইরকম, “শিল্পকলা একাডেমিতে যদি সুযোগ পাই, আমি চাইবো ওখানে জামায়াত যেন আসে, এইজন্য যে, বলুক কেন মেয়েদের এখনো ২০২৪ সালে বোরখা পরতে হবে? তারা আমাদের কনভিন্স করুক কেন শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা দরকার! কারণ কোরানেই বলা আছে তুমি কোনো নারীর দিকে চোখ পড়লে দৃষ্টি নামাও, আমি যদি দৃষ্টি নামাই, আমি যদি সংযত হই তাহলে কেন নারীকে ঘোমটা দিতে হবে?” যাবতীয় মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখলেই বুঝা যায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের মনস্তত্ত্ব! জেহাদি ভাইয়েরা চোখ নামানোর চেয়ে নারীদের পোশাকআশাক দিয়ে ঢেকে রাখার পক্ষে। এমনিতেই আমাদের পোশাক আশাকে বেশ একটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আমাদের অর্থনীতিকে একটা ভিত্তি দিয়েছেন বটে সেই সাথে নিয়ে এসেছেন ঐ দেশীয় পোশাক, সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠান! তার উপর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব তো আছেই। পাল্টে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। এখন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হবে। যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ধারক বলে ধরে নেওয়া হতো তাদের সন্তানদের স্বপ্নসাধ বাংলাদেশের বাইরে পাশ্চাত্যের চকচকে দুনিয়ায়। সুতরাং সেই জায়গাটাও আগের মতো আর নেই! এই নতুন সংস্কৃতির সাথে পুরনো আত্মপরিচয়ের জায়গায় একটা দ্বন্দ্ব তো তৈরি হচ্ছেই। কোনটা পথ কোনটা বিপথ এনিয়ে দিশেহারা অবস্থা। তার সাথে নারীর পোশাকেও এসেছে পরিবর্তন! শার্ট প্যান্ট যেমন পরছে তেমনি বোরখা হিজাবও দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। খুব বেশি দিনের কথা নয়, আশির দশকের কথা বলছি আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তখনও কিন্তু দেখেনি কেউ বোরখা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে। শালীনতার ব্যাপার নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। শহর থেকে এতদূরে ক্যাম্পাস হলেও ছাত্রীদের সাথে কোনোরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে এমন প্রমাণও নেই। এবার আসি শরিয়া আইনে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রসঙ্গে। আফগানিস্তান আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। দীর্ঘ যুদ্ধের পর তালেবানেরা ২০২১ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নেয়। চালু করে শরীয়া আইন। তারপর থেকে সব জায়গা থেকে নারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছু নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। আফগানিস্তানে ৩০০ জনেরও বেশি নারী বিচারক ছিলেন তাঁরা নারীদের সমস্যা থেকে শুরু করে ফৌজদারি এবং সন্ত্রাস সম্পর্কিত মামলার সবরকম বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। এখন অনেকে পালিয়ে বেঁচেছেন আবার অনেকে আত্মগোপনে। একজন সাবেক নারী বিচারপতি বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিচার বিভাগে নারী না থাকলে, নারী ভুক্তভোগীরা আদালত থেকে সাহায্য ও ত্রাণ চাইতে পারেন না। এটা শুধু নারী অধিকারের ব্যাপার নয় সামগ্রিকভাবে মানবাধিকারের জন্য বড় ক্ষতি। দেশের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আইনী সহায়তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আফগানিস্তান হলো বিশ্বের সবচেয়ে নারী নিপীড়নকারী দেশ। সেখানে ধর্মীয় আইনের বেড়াজালে নারীকে ঘরে আটকে রাখা হয়। তিন কোটি আশি লাখ মানুষের দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ খাদ্যাভাবে ভুগছে। অপুষ্টিতে ভুগছে লাখলাখ শিশু। ক্ষমতা দখলের পর থেকে সরকারি তো বটেই বেসরকারি সংস্থাগুলিতেও নারীদের কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আফগানিস্তানে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ নারী স্বামী হারান। তাদের ছোট ছোট শিশুদের ভরনপোষণ করার জন্য তাদের কাজ দরকার, উপার্জনের সুযোগ দরকার। কিন্তু সরকার নারীদের সবরকম উপার্জনের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। মাহরাম ছাড়া কোনো নারীর ঘর থেকে বের হওয়া আইন বিরুদ্ধ। আইন ভঙ্গের অপরাধে নারীদের দোররা মারা হয় উন্মুক্ত স্থানে। চারপাশে পুরুষ দর্শকেরা ঘিরে থাকবে। দোররার আঘাতে কষ্ট হলেও কোনো শব্দ করা যাবে না। নারীর শব্দ বা আর্তনাদ কোনো পরপুরুষের কানে পৌঁছানো গুনাহ ও আইনবিরুদ্ধ। ইসলামে নারীদের যে সম্মান ও অধিকার দিয়েছে তা আমরা এখানে খুঁজে পাই না। আমরা জানি কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের পার্থক্য ছাড়া ইসলামের সকল নিয়মই নারী পুরুষের জন্য সমান। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই ধর্মভীরু। কিন্তু বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার তারা পছন্দ করে না। সবচেয়ে বড় কথা মন ও মগজের ভেতর এত অন্ধকার নিয়ে কীভাবে দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নেওয়া যাবে! কারো না কারো তো সর্বমানুষের কথা বলে হাল ধরতেই হবে। আসুক না কিছু জামিল সাহেবদের মতো মানুষ। বলুক না কথা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নস্যাতে কাজ করছে একটি চক্র
পরবর্তী নিবন্ধবীর চট্টগ্রামে ওরা বিজয়িনী