আশা ও অনিশ্চয়তার সন্ধিক্ষণে ব্যাংকিং খাত

মোহাম্মদ আব্দুল মুবিন গাজী | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত এক বছরে এক নাটকীয় উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের আগস্টে যখন ১১টি বেসরকারি ব্যাংক কার্যত ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয় বাজারে টাকার জোগান বাড়াতে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা নতুন অর্থ ছাপিয়ে এই সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে টেনে তোলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘অস্থায়ী অক্সিজেন’ আসলে দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার পথ খুলেছে, নাকি সাময়িকভাবে রোগীর প্রাণ বাঁচানোর মতোই কাজ করেছে?

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগেসংকটকালীন সময়ে টাকার জোগান বাড়ানো কতটা কার্যকর সমাধান হতে পারে। অর্থনীতিতে অতিরিক্ত টাকা প্রবাহিত হলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়ে, পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। ফলে ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে গিয়ে পুরো অর্থনীতিই চাপের মুখে পড়ে। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রকৃত সমাধান হতে হবে কাঠামোগত সংস্কার ও দুর্বল ব্যাংকগুলোর কার্যকর পুনর্গঠন।

অন্যদিকে, ব্যাংক খাতের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন, পরিচালনা পর্ষদে অনিয়মিত প্রভাব এবং বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি শিথিল নীতি বর্তমান সংকটকে আরও জটিল করেছে। যদি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা যায়, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব ধরনের উদ্যোগও অকার্যকর হয়ে পড়বে। তাই স্বল্পমেয়াদি সহায়তার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

গত ২৬ মার্চ ২০২৫ তারিখে, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড একটি বিশ্লেষণধর্মী বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, পুনর্গঠিত বোর্ড ও কৌশলগত পদক্ষেপের ফলে ১১টির মধ্যে ছয়টি ব্যাংক ইতিমধ্যেই আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। এসব ব্যাংক হলোইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউসিবি, আইএফআইসি এবং আলআরাফাহ ব্যাংক। নতুন করে আমানত সংগ্রহে তারা সফল হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক মাত্র ছয় মাসে ১৭ হাজার কোটি টাকা নতুন আমানত সংগ্রহ করেছে, যা সাধারণ গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসার বড় প্রমাণ। আইএফআইসি ও ইউসিবিও আমানত বাড়াতে এবং তারল্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। এর পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারি ও বোর্ডে নতুন নেতৃত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

তবে ইতিবাচক চিত্রের আড়ালে উদ্বেগও কম নয়। যে কারণে ব্যাংকগুলো আজকের এই মুমূর্ষু অবস্থায়; অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ, একই গোষ্ঠীর হাতে বিপুল আমানতের ঘনত্ব, এবং দুর্নীতি। এসব সমস্যা এখনও পুরোপুরি সমাধান হয়নি। ইতোমধ্যেই সুপ্ত খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। ফলে ভবিষ্যতে লাভজনকতা ও স্থিতিশীলতা আবারও হুমকির মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ভাষায়, খাতের গড় খেলাপি ঋণ যদি ৩০ শতাংশেও পৌঁছায়, তবুও বাস্তব চিত্র গোপন করা যাবে না।

সবচেয়ে বিপজ্জনক চিত্র পাঁচটি ব্যাংককে ঘিরে। এর মধ্যে চারটিই দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব ব্যাংকে একক গোষ্ঠীর কাছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত আমানত কেন্দ্রীভূত ছিল, যা আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মানদণ্ডের চরম লঙ্ঘন। এখন গ্রাহক আস্থা না ফিরতে পারায় প্রতিদিনই তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাস্তবে এই ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে পারছে না, ঋণ কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে আছে। সুতরাং এগুলো পুনরুদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

এখানে ন্যাশনাল ব্যাংকের অবস্থার কথাও উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন ধরেই পরিবারতন্ত্র ও দুর্বল শাসনব্যবস্থার কারণে এ ব্যাংক ধুঁকছিল। কিন্তু দেরিতে হস্তক্ষেপ করায় তা এখন আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমানত কমে গেছে, কর্মকর্তারা চাকরি ছাড়ছেন, নতুন করে আমানত সংগ্রহও কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রস্তাবিত ব্যাংক রেজোলিউশন আইন। খসড়া অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দেওয়া হবে দুর্বল ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে। অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ, একীভূতকরণ, এমনকি সেতু ব্যাংক গড়ে তোলা পর্যন্ত। এটি বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন খাতের স্বচ্ছতা বাড়বে, অন্যদিকে ‘খারাপ ব্যাংক বাঁচাতে ভালো ব্যাংকের ঝুঁকি নেওয়া’ সংস্কৃতি থেকেও বের হয়ে আসা সম্ভব হবে। তবে প্রশ্ন হলোআইন প্রণয়ন হলেও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে তা কার্যকর করা যাবে কি না!

সবশেষে, ব্যাংক খাতের বর্তমান সংকট একটি বড় শিক্ষা দিয়েছে। আমানতকারীর আস্থা একবার হারালে কেবল টাকা ছাপিয়েই তা ফেরানো যায় না; দরকার জবাবদিহি, সুশাসন ও সঠিক নেতৃত্ব। ৩০ হাজার কোটি টাকার সাপোর্ট যদি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পথ তৈরি করে, তবে তা যৌক্তিক বিনিয়োগ। কিন্তু যদি তা কেবল দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠীগুলোকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার হাতিয়ার হয়, তবে এর খেসারত দিতে হবে পুরো অর্থনীতিকে। ব্যাংক খাতের এই রূপান্তর এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। কয়েকটি ব্যাংকের পুনরুদ্ধার আমাদের আশা জাগায়, কিন্তু অন্যগুলোর অনিশ্চয়তা আমাদের সতর্ক করে। আস্থার সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে কেবল টাকা নয়, প্রয়োজন নীতি, নৈতিকতা ও নিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদীর আলোয় নারী লেখকদের গৌরবযাত্রা
পরবর্তী নিবন্ধসমম্বয়বাদের মূল সুর – ইউসুফ মুহম্মদের দোঁহা