আশা আকাঙ্ক্ষায় নিরাশার দোলা

নাসের রহমান | বৃহস্পতিবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

উৎকণ্ঠা উদ্বেগ আর শঙ্কার মধ্য দিয়ে দিন কাটে। অনিশ্চয়তা আর অশান্তিতে ভরা দিন রাত। কোথাও শান্তি নেই, কোথাও স্বস্তি নেই। আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে। দীর্ঘ আলাপ আলোচনায় কোনো পথ খুঁজে পাইনি। সন্দেহ ও অবিশ্বাস আস্থাহীনতার দিকে গিয়ে গিয়েছে। কারো প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই, কারো প্রতি কারো আস্থা নেই। মতপার্থক্য বা মত ভিন্নতা বড় নয় আস্থাহীনতা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ বড় হয়ে গিয়েছে। সিন্ধান্তহীনতা বিভ্রান্তিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঐক্য অনৈক্যের দোলাচলে সবকিছু আটকে গিয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে ইস্যু করে মৌলিক বিষয়গুলো পাশ কেটে গিয়েছে। মূল বিষয় থেকে দূরে সরে গিয়েছে। বিভেদ ও বিভাজনের পথকে সুগম করে দিয়েছে। আশা আকাঙ্ক্ষা নিরাশায় নিমজ্জিত হয়েছে।

মৌলিক বিষয়ের মধ্যে গণতন্ত্র বা সুশাসন অন্যতম। গণতন্ত্রের উত্তরণে নির্বাচন অপরিহার্য। নির্বাচনের আগে কেউ বলে সংস্কার, কেউ বলে বিচার। এ নিয়ে সময় ক্ষেপণ হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনও প্রায় বছর জুড়ে আলাপ সংলাপ করে সবাইকে ঐকমত্যে আনতে পারেনি। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, বিচার আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত কমিশন। কিন্তু নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মতানৈক্য এখনো হয়নি। ফলে নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা তা পুরোপুরি কাটেনি। এর সাথে আবার যুক্ত হয়েছে গণভোটের বিষয়। আসলে সাধারণ মানুষ চায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। যেখানে নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারে। পছন্দের প্রার্থীকে দিতে পারে। ভোট নিয়ে মানুষ কোনো ধরনের জটিলতায় যেতে চায় না।

এরপর শান্তি শৃঙ্খলার বিষয়টি আসে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সবাই চায়। শৃঙ্খলা বজায় না থাকলে কোনো কিছু সম্ভব নয়। এজন্য আইন শৃঙ্খলার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। নিরাপত্তাহীনতায় কেউ থাকতে চায় না। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শুধু নিরাপত্তা নয় অন্যসব ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আবার নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরে আসতে চায়। একুটু সবাই নিশ্চিত হতে চায়। তা এখনো হয়ে ওঠেনি। আইন শৃঙ্খলার ক্রমাবনতি জনমনে নানা ধরনের শঙ্কার উদ্রেগ ঘটায়। জন নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। জোর জবরদস্তি ও বল প্রয়োগ তার সাথে ‘মবের’ দৌরাত্ম্যে মানুষ সর্বদা আতঙ্কের মধ্যে থাকে। কখন কার ওপর কী ঘটে যায় কিছুই বলা যায় না।

সন্তানেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে মাবাবারা উৎকণ্ঠায় থাকে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে যে আন্তরিক সম্পর্ক তা আর ফিরে আসেনি। ছাত্র ছাত্রীদের কোচিং নির্ভরতা আরো বেড়ে গিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস করার চেয়ে কোচিং সেন্টারের ক্লাসে তারা অনেক বেশি মনোযোগী। শিক্ষার নানা ধরনের অনিয়ম অব্যবস্থাপনা কোনো কিছুই কমেনি। নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জায়গা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে নানা রকম বিশৃঙ্খলা, আশা আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন নেই।

দাবী আদায়ের নামে যেভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয় তাতে চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এমনিতে যানজটের জন্য চলাফেরা করা দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে। তীব্র যানজট যেন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। স্কুল টাইম বা অফিস টাইম বলে কথা নেই। যখন তখন যেখানে সেখানে যানজট লেগে যায়। কেউ নিয়ন্ত্রণ করে বলে মনে হয় না। যাদের দায়িত্ব তারা যেন নিস্ক্রীয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদেরকে কেউ মানতে চায় না। মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এতো দাবী দাওয়া আদায়ের মিছিল আগে ছিল না। মিছিলের চেয়ে বড় কথা রাস্তায় বসে পড়া। এভাবে বসে পড়ে কি দাবীধাওয়া আদায় করা যায় তা দেখার কেউ নেই। পুলিশের সাথে চলে এদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপ। এর থেকে বের হওয়ার কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। এতে করে জনমনে যে শঙ্কা তা আর কাটে না। দুর্ভোগ বাড়ে, ভোগান্তি বাড়ে। মানুষের মনে স্বস্তি আর ফিরে আসে না।

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সবসময় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকে। সীমিত আয়ের মানুষের জীবন যাত্রার মান অনেক নিচে নেমে গিয়েছে। সব শ্রেণি পেশার মানুষ দ্রব্য মূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত। সিন্ডিকেটের কবল থেকে দ্রব্য মূল্য বেরিয়ে আসতে পারেনি। সম্পূর্ণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। কোন কোন দ্রব্যের মূল্য হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়ে আকাশচুম্বী হয়ে যায়। সহজে আর নামে না। সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। বাজার কারসাজিতে মানুষের নাভিশ্বাস হয়ে যায়। কোনো পক্ষ থেকে বাস্তব উদ্যোগ নেই। দিনে দিনে মাসে মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে এমন জায়গায় পৌঁছে যায় মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে বাধ্য হয়। পরিবার পরিজন নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটায়। এমনো অনেক পরিবার আছে যাদের অর্ধাহারে থাকতে হয়। অনাহারেও থাকে অনেকে। এর থেকে পরিত্রাণ চায় সবাই। দুবেলা খেয়ে পরে বাঁচার অধিকার সবার আছে।

কোনো কর্মসংস্থান নেই, বিনিয়োগ নেই, ব্যবসা বাণিজ্য পুরাপুরি সচল হয়নি। অনেক শিল্প কলকারখানা অচয় হয়ে পড়েছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। শিক্ষিত তরুণদের বছরের পর বছর বেকার থাকতে হচ্ছে। আয়ের পথ সব রুদ্ধ কিন্তু খরচ থেমে নেই। ক্ষুদ্র মাঝারী বা বড় ব্যবসায়ী কারো ব্যবসায়ে গতি নেই। ব্যবসা বাণিজ্যে এ ধরনের অবস্থা আগে কখনো হয়নি। অর্থনীতি যেন গতিহীন হয়ে পড়ছে, স্থবির হয়ে পড়ছে। এভাবে আর বেশি দিন চলতে থাকলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। তখন আর তোলা যাবে না। এজন্য সময় থাকতে ব্যবস্থা নিতে হবে। সঠিক পথে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালিত করতে হবে। ভালো ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিতে হবে। তারা যেন ভয়ভীতির মধ্যে না থাকে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ভয়ভীতি ও হয়রানির মধ্যে থাকলে ব্যবসাবাণিজ্যে গতি ফিরে আসবে না। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য দেশের ব্যবসা বাণিজ্যকে স্থবির করে দেয়া যায় না। এতে করে শুধু ব্যবসায়ী মহল নয় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

এসব মৌলিক বিষয়ের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এগুলো কেউ পরিহার করতে পারে না যা দৈনন্দিন জীবন যাপনে অপরিহার্য। বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে না পারলে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। দ্রব্যমূল্যকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে না পারলে জনজীবনের দুর্ভোগ কমবে না। এজন্য এসব মৌলিক বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যবসাবাণিজ্যও গুরুত্বপূর্ণ। জন আশঙ্ক্ষার চেয়েও এসব মৌলিক বিষয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। সংস্কার, বিচার, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আগ্রহ কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন এসব মৌলিক বিষয়ের। বিশেষ করে জন নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষার পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা, সর্বোপরি স্বাভাবিক জীবন যাত্রার নিশ্চয়তা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনা ও কিছু কথা
পরবর্তী নিবন্ধশিল্পকলায় গ্রুপ থিয়েটার উৎসব কাল থেকে