রুম্পা, আমার ঘরের কাজে সাহায্যকারী। সে স্বামী পরিত্যক্তা। মার্চ মাসের ২২ তারিখ ছেলের অসুস্থতার কারণে বাড়িতে যায়। এর কিছুদিন পর নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে। লকডাউন আর করোনা ভীতির কারণে বাসায় আসতে বারণ করে দেই। রুম্পার মেয়ে একটা ছোট পার্লার চালায়। ছেলেটা একটা ছোট চাকরি করে রাঙামাটি। এক ভাই ড্রাইভার, আরেকভাই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। বোন স্বামী পরিত্যাক্তা, গারমেন্টস চাকরি করে। বাড়ি চিটাগাং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কাছে। পাহাড়ি জায়গা, বেশিরভাগ লোক দখল করে ছোটছোট বাড়ি করে আছে। শিক্ষক ভাইয়ের স্কুল বন্ধ, ড্রাইভার ভাইয়ের চাকরি নেই, বোনের গার্মেন্ট্স বন্ধ, মেয়ের পার্লার বন্ধ, করোনার কারণে আমিও রুম্পাকে বাসায় আসতে বারণ করেছি, বয়স্ক অসুস্থ মা’য়ের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে। কাছাকাছি থাকলেও রুম্পার ভাইবোন সবার আলাদা আলাদা সংসার। সবার আয়-রোজগার একসাথে বন্ধ। আজ কোনভাবে চলছে, কাল কিভাবে চলবে তার কোন সংস্থান নেই। এর ওপর প্রত্যেকেই কিস্তিতে ঋণ নিয়ে রেখেছে বিভিন্ন প্রয়োজনে। কেউ ঋণ নিয়েছে বাড়ি মেরামতের জন্য, কেউ মায়ের চিকিৎসার জন্য, কেউ নিজের বিয়ের খরচ যোগাতে, কেউ বা নিয়েছে পার্লার করতে, আবার কেউ নিয়েছে ছেলের চাকরির ঘুষের টাকা যোগাড় করতে। কিস্তি পরিশোধ করতে হয় প্রতি সপ্তাহে। পরিশোধের প্রেসার যে কিস্তিতে ঋণ নেয়নি, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। করোনার কারণে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। জমার ঘর শূন্য। কাল কিভাবে সংসার চলবে তার কোন ব্যবস্থা নেই, কিস্তি পরিশোধ তো দূরের কথা। প্রথম ১৫ দিন কোনভাবে কাটে। হাতের টাকা পুরো শেষ। আবার নিতে হয় সেই ঋণ। কিছু হাঁস মুরগী ছিল আগে থেকে, ডিম বিক্রি শুরু করে, সাথে কিনে নেয় আরও কিছু হাঁস-মুরগী। শুরু করে সব্জি চাষ। পাহাড়ি জায়গা, যে কেউ চাষ করতে পারে ওই জমিতে। অল্পকিছুদিনেই শাকসব্জির ফলন শুরু হয়। তিন-চারমাসের মধ্যেই পুরোপুরি কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়ে রুম্পার পুরো পরিবার। লকডাউনে পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও বিক্রি করেছে আশেপাশে, দু’পয়সা রোজগারের জন্য। পেট তো ‘করোনা’ বুঝবে না। অন্য সবকিছু বিসর্জন দিলেও খেতে তো হবে বেঁচে থাকার জন্য, একজনকে দেখে অন্যজন, এরপর আরেকজন, এভাবে করতে করতে পুরো গ্রামের সবাই এখন কৃষি কাজ, পশুপালনে ব্যস্ত। এরই মাঝে ঋণ নিয়ে কয়েকজন মিলে পাহাড়ের জায়গা লিজ নিয়ে শুরু করেছে বিভিন্ন ফলমূলের বাগান। দু-তিন বছরের মধ্যে আশাকরা যায় ভালোই ফলন পাবে। শিক্ষক ভাই এখন বাগানের পাশাপাশি ছোট গরু-ছাগল কিনে একটু বড় করে আবার বিক্রি করে দিচ্ছে বেশি দামে। আশা করি রুম্পাকে এখন আর সাহায্যকারী হিসেবে কারও বাড়িতে কাজ করতে হবে না, ড্রাইভার ভাইও বাড়িতে থেকে চাষাবাদ করে ভালোই রোজগার করছে পরিবারের সাথে থেকে। স্কুল খুললে শিক্ষক ভাই হয়তো চাকরিতে জয়েন করবে আবার, কিন্তু পাশাপাশি তার ছোট ব্যবসাও চালিয়ে যেতে পারবে।
গ্রামের স্কুলের এই শিক্ষক হয়তো এটা-ওটা করে জীবিকা নির্বাহ করছে, কিন্তু শহরের বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থা? স্কুল বন্ধ, চলছে না বেতন, প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ, কোচিং বন্ধ, বাড়িভাড়া, বাচ্চাদের স্কুল কলেজের খরচ, খাওয়া-পড়া, চিকিৎসা ইত্যাদি সব খরচ চলছে কিভাবে! বাড়িওয়ালা সদয় হলে বাকি পড়ছে বাড়িভাড়া, বাচ্চাদের স্কুল খরচও হয়তো বাকি পড়ছে, কিন্তু দৈনন্দিন খরচ তো বসে নেই। চলছে কিভাবে এসব খরচ! কিছু সুহৃদ বাড়িওয়ালা কয়েকমাস বাকি বাড়ি ভাড়া মাফ করে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাড়িওয়ালাদের দোষ দেয়া যাবে না। কারণ কিছু কিছু বাড়িওয়ালাকে এই বাড়ি ভাড়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু যাদের বের করা হলো তারা যাবে কোথায়? গ্রামে?
ক’দিন আগে পার্লারে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয় মাত্র ১৫-২০ শতাংশ কর্মী নিয়ে পার্লার চলছে। যে মেয়েটা সবসময় আমার চুল কাটতো, সেও নেই। মেয়েটার তিন বাচ্চা, দুটো স্কুলে পড়তো, একটা কোলে। স্বামী বাচ্চা আর সংসার সামলাতো, মেয়েটা পার্লারে কাজ করে রোজগার করতো। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে একজনের আয়ে কতটা কষ্ট করে মেয়েটাকে চলতে হতো। বাড়ি ভাড়া, বাচ্চাদের স্কুল, সংসার খরচ ইত্যাদি ইত্যাদি। করোনা শুরু হলে পার্লার বন্ধ হয়ে যায়, বেতন বন্ধ। ছেড়ে দিতে হয় বাসা। চলে যায় গ্রামে। আরেকটা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ম্যাডাম অন্যদের এখনও আসতে বলেনি। গ্রামে সবাই কি করছে জিজ্ঞাসা করায় জবাব এলো, ‘সবাই খুব কষ্টে আছে, কোন কাজ নেই ওদের গ্রামে।’ আর বেতনও বন্ধ। আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। বাসায় এসে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি দুদিন। ফোনটা বন্ধ। হয়তো ফোন খোলা রাখার পয়সাটুকুও নেই এখন আর!
বন্ধ থাকায় পার্লারগুলোর মত আরও অনেক পেশার লোক বেকার হয়ে পড়েছে। প্রায় আট মাস পর এয়ারপোর্টে গিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ছুটোছুটি নেই, লোকজন নেই, খাঁ খাঁ করছে এয়ারপোর্টের চারদিক। নির্জনতা এয়ারপোর্ট, হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোকে গিলে খাচ্ছে। প্রাইভেট অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এই লোকগুলো কোথায় কি করছে, কিভাবে চলছে কে জানে! বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছবিও একই রকম, কর্মচারী অর্ধেকও নেই, পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। মার্কেটগুলো খোলা থাকলেও নামমাত্র ক্রেতাসমাগম। আয়-রোজগারের সব পথ বন্ধ। ভবিষ্যত চিন্তায় এরা জর্জরিত। কি এক দৈন্য দশা চলছে সারা দেশে তথা সমগ্র পৃথিবী জুড়ে! একদিকে রোজগার কমে গেছে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’!
করোনা মহামারির কারণে অনেকে কাজ হারিয়েছে ঠিকই, কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে অনেকের সামনে খুলে গেছে অনেক নতুন দুয়ার। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তদের ভোগান্তি অনেক বেশি। সম্মানের দিকে তাকিয়ে চট্ করে যে কোন কাজ তারা করতে পারছে না। আবার জমার ঘর শূন্যের কোঠায় হওয়াতে পুঁজি খাটিয়ে কোন কাজ পারছে না। তাদের পক্ষে কোনদিন সম্ভব হবে না গ্রামে গিয়ে সরকারি জমিতে ফসল ফলানো কিংবা দখলি জায়গায় নিজের আবাস গড়ে তোলা। কি করবে বুঝতে বুঝতেই দীর্ঘ আটমাস কেটে যাচ্ছে, বছরও হয়তো গড়িয়ে যাবে ভাবতে ভাবতেই। ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের অবস্থা আরো শোচনীয়, হাতে তাদের ক্যাশ টাকা থাকে না, সবটাই ব্যবসার কাজে লাগানে থাকে। এই ঝড় তাদের একেবারে পথে এনে দাঁড় করিয়েছে। যাদের হাতে এখনও জমা কিছু টাকা আছে তারা কোনভাবে চলছে, আর ভবিষ্যত চিন্তায় মরছে। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে মনে হলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন অনিশ্চিত ভবিষ্যত, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। অনেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে চাকরিতে যোগ দেয়ার কথা এতদিনে। বাবা-মা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পার করেছে এই সুদিনের আশায়। কিন্তু করোনার কারণে ঝুলে গেছে তাদের স্বপ্ন। আজ কোনভাবে চলে গেলেও, কাল কিভাবে চলবে তা ভেবে ভেবে অস্থির সবাই। ভুক্তভোগীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে হতাশাগ্রস্তদের সংখ্যা, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে অনেকে, অসৎ পথে হাঁটতে হচ্ছে পেটের দায়ে, আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার পথ হারিয়ে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ!
কেটে যাচ্ছে বিষাদময় ২০২০, উঁকি দিচ্ছে ২০২১। আশার আলো দেখবার অনেক চেষ্টা করেও ক্ষীণ আলোর রেখাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কেমন কাটবে ২০২১? প্রশ্ন আছে কিন্তু জবাব এখনও মিলছে না। হাসতে চাইলে জোর করে হাসতে হয়, বুকে চাপা কষ্ট, হতাশা এখন নিত্য সঙ্গী! তবুও মানুষ তো, আশায় বুক বাঁধতেই হয় বেঁচে থাকার জন্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার