প্রকৃত কবিতা আপন কালের সাম্প্রতিক কালসন্ধি অতিক্রম করে নিজস্ব প্রকাশকৌশলের চারিত্র গঠন করে। সময়ের চিন্তাদর্শেই লালিত হয় কবিতার আত্মা। ভাষার দ্বান্দ্বিক অলংকরণে নির্মিত হয় কবিতার দেহ, ছন্দ্যানন্দনে প্রকাশ পায় যুগের চলন। কবিতার কাব্যাত্মার মধ্যেই রূপময় হয়ে ওঠে বাস্তব জগতের নন্দন। অর্থাৎ যে বাস্তব হাজির থাকে ভাষার শরীরে ও প্রতিবেশ বেষ্টনীতে তা–ই প্রকৃত কাব্যাদর্শ। নন্দনতত্ত্ব, জটিল বাস্তব ও নবতর আঙ্গিক বিনির্মাণই কবিতার বিবর্তনভূমি।
আল মাহমুদ কবিতার শরীর নির্মাণে সময় ও ইতিহাসের আর্থ–সামাজিক ও ভূ–রাজতৈিক নির্যাস ব্যবহারকারী এক নিপুণ কারিগর। কাব্যাত্মা নির্মাণের প্রকৌশল অসাধারণ প্রতিভায় বাঙময় হয়ে আছে তার প্রতিটি সনেট ও কবিতার দেহজ ভাঁজে। আজীবন শ্রেণিবৈষম্যের বিষদাঁত উৎপাটনে সক্রিয় সৈনিক আল মাহমুদ তাঁর কবিতার বরাতেই সে কথা প্রতীয়মান করার চেষ্টা করেছেন। পুঁজিবাদ, পুঁজির অবৈধ আবর্তন, দেশ–সীমা লঙ্ঘন, নিজস্ব ভূ–ভাগ, নিসর্গ, নারী, এসবের উপর কালোথাবা আল মাহমুদ কোনো কালেই বরদাশত করেননি। আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় সোনালী কাবিনসহ অন্যান্য সনেটগুচ্ছে।
কবির ‘দোয়েল ও দয়িতা’ কাব্যের খরা সনেটগুচ্ছে এসবের দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। আল মাহমুদ নদীর পাড়ভাঙা কবি। চোখের সামনেই তিতাসের পাড় ভাঙতে দেখেছেন, দেখেছেন নিজের বসতভিটা আর ফসলী জমির বিলীন হওয়ার দৃশ্য। তাই বাংলাদেশের কোন নদীর বিলোপ কবি সহ্য করতে পারেন না। খরা সনেটগুচ্ছের ১,২, ৫ ও ৬ নং সনেটে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রতীয়মান।
নদীর মরণ দেখে তোমাকেই জীবনের জল হতে বলি
বসন উদ্ভিদ হোক, অলংকার শৈবাল যেমন
একভাগ মাংসমেদ তিনভাগ ভক্তের অঞ্জলি
এরি মাঝে স্নানপান প্রক্ষালন, বাঁচার বেদন।
তোমাকেই পান করি, অজুর বক্ষিত জলাধার
সে–পানি ছিটোই বুকে, সরোবর ধরেছি গণ্ডুষে
খরার মধ্যাহ্নে তুমি ঘুর্ণিতোলা মেঘের ভাণ্ডার
ঝরো ঝরো– প্রার্থনায় তোমাকেই নিতে যাই শুষে।
(খরা সনেট– ১)
সূর্যের কি সাধ্য বলো শুষে নেয় তোমার উরস?
লাবণ্যের উৎসমূল, দুগ্ধশ্বেত অনাবৃত হাত
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরো বৃক্ষচোষা খেজুরের কষ
ভরুক সুধায় সিক্ত শূন্যে বাঁধা আমার হায়াত।
তাকাও মুখের পানে নিঃশেষিত নদীর অবশ
বদ্ধ জলে মহাশোল খুঁজি আমি তোমার প্রপাত।
(খরা সনেট– ২)
তুমি কি আকাশগঙ্গা? মন্দাকিনী? নদীদের মাতা?
সহস্র মাছের চোখে এঁকে দাও পুষ্টির কাজল,
প্রকৃতির বরাভয়ে বাষ্পময় আর্দ্রতার খাতা–
খাতার পাতায় কষা যোগফল, পিপাসার জল?
প্রান্তরের মরানদী স্রোত চেয়ে ফেলে দীর্ঘশ্বাস
এবার তোমার তিস্তা খুলে দাও, তোমার তিতাস।
(খরা সনেট– ৬)
নদী সিকস্তী গাওয়া আল মাহমুদের চিরায়ত স্বভাব। খরস্রোতা নদী, জেগে ওঠা নতুন চর, চরে চড়ে বেড়ানো গরু, রাখাল, উগল মাছ সবে কবির দরদমাখা আগ্রহ। নদীর মরণ কিংবা নদীর গতিপথ রোধ আল মাহমুদের চেতনাকে বিদ্ধ করে। চেতনার বিদ্ধহুলে কবি হয়ে উঠেন প্রতিবাদী আর তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র একমাত্র কবিতা। এদেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে নদী। নদীকে ঘিরেই জীবিকা নির্বাহকারী প্রথম সারির নাগরিক সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের অকল্যাণ কবির কাব্যাত্মাকে ব্যথিত করে।
নদীর মরণ দেখে তোমাকেই জীবনের জল হতে বলি
বসন উদ্ভীদ হোক, অলংকার শৈবাল যেমন
(খরা সনেট ১)
শুকিয়ে যাওয়া নদী, মরা মাছের মংকাল, ভোঁদড়ের মরা চোখ এই দৃশ্য ও চিত্রকল্প বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদীর, নদীর মৃত্যুর সাথে কবির নয় ষোলোকোটি মানুষেরও ইচ্ছার মৃত্যুকে তুলনা করেন কবি।
নদীর মৃত্যু মানে ফসলের অনাবাদ, ফসলের অনাবাদ মানে মঙ্গা, মঙ্গা মানে অনাহারে মানবসন্তানের মৃত মুখ, অর্থনীতির শ্লথগতি। অর্থনীতির গতি শ্লথ মানে জাতি রাষ্ট্রের মৃত্যু আর জাতিসত্তার বিলোপ। কবিরা সুদূরে দেখেন, আল মাহমুদও তাই আগাম বলে দেন। তবে বাংলাদেশের খরেস্রোতা নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়া বা শুকিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে যাদের কালো হাত তাদেরকে কবি একহাত নিয়েছেন।
মা– গঙ্গার শাড়ী খুলে ফারাক্কায় গঙ্গা পূজারীরা
বেঁধেছে প্রবাহমান সঞ্জীবনী নদীর উজান,
কখনো ডেকেছি যারে যমুনা, জাহ্নবী, সদানীরা
মানুষের ধর্মেকর্মে, রূপকে, গাথায় চলমান–
হে পদ্মা প্রলয়ঙ্করী, কীর্তিনাশা, ভৈরবী সুন্দরী;
(খরা সনেট– ৫)
বাংলাদেশের গঙ্গা, যমুনা, জাহ্নবী, পদ্মা, কীর্তিনাশা, ভৈরবী নদীগুলো আজ কোন এক অজগরী মন্ত্রবলে দড়ি হয়ে গেছে, কিংবা শামুকের খোলসের আশ্রয় নিয়েছে। তবে এসব যারা করেছে, কবি তাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
মা– গঙ্গার শাড়ী খুলে ফারাক্কায় গঙ্গা পূজারীরা
বেঁধেছে প্রবাহমান সঞ্জীবনী নদীর উজান,
——————————–
নদীর গর্জন শুনে প্রাণ পাক এদেশের বিরাণ অঞ্চল
ফাটল বেয়ে আবার নামুক গঙ্গা। সকলের জল।
নদীর শত্রুদের চরিত্র চিত্রনে আল মাহমুদ দেখিয়েছেন সুনিপুণ মুন্সিয়ানা। তার ক্ষুরধার কলমি আঁচড়ে সপাং সপাং আঘাত হেনেছেন নদীর নাব্যতা হরণকারীর লোমশ বুকে। এতসবের পরেও আল মাহমুদ হতাশ নন। আশাবাদী শব্দের চাষাবাদকারী আল মাহমুদ আশার বীজ রুয়ে দেন নদীর পাড়ে। নদীর লাবণ্যকে করেন সূর্যের প্রতিপক্ষ।
সূর্যের কি সাধ্য বলো শুষে নেয় তোমার উরস?
লাবণ্যের উৎসমূল, দুগ্ধশ্বেত অনাবৃত হাত
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরো বৃক্ষচোষা খেজুরের কষ
ভরুক সূধায় সিক্ত শূন্যে বাঁধা আমার হায়াত।
তাকাও মুখের পানে নিঃশেষিত নদীর অবশ
বদ্ধ জলে মহাশোল খুঁজি আমি তোমার প্রপাত। (খরা সনেট– ২)
কবি বলেন–
মরা ঝঞ্ঝাবাতে চিরদিন উড়িয়ে আঁচল
তোমার চলায় নড়ে ধরিত্রীর গর্ভভরা জল। (খরা সনেট– ৩)
নদী–ই জলজ আর্দ্র বাংলার রোজগারের অন্যতম সহায়ক অনুষঙ্গ। কবির কথামালায় ভেসে ওঠে তার চিত্রকলা।
আল মাহমুদ আজীবন সাম্যবাদী ছিলেন। তাই শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে থেকে কষাঘাত করেছেন পুঁজিবাদের দৈত্যাবয়বে।
তাঁর অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না কাব্যে ‘ইহুদীরা’ কবিতায় পাই –
ইহুদীরা হাসুক / সম্পদের সুষম বন্টন অনিবার্য / ইহুদীরা নাচুক, তবু / ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন, আর /মানুষ মানুষের ভাই।
সেই আদিকাল থেকে ইহুদীদের শোষণনীতি এবং পীড়িতজনের আর্তনাদ এক আদিম প্রপঞ্চ। কিন্তু আল মাহমুদ ইসলামের সাম্যবাদী অর্থনীতির পক্ষে। তার গুরু সাহাবী– আবু জর গিফারী। সেই মূলমন্ত্রে উদ্বেলিত আল মাহমুদ পৃথিবীর মানচিত্রে পুঁজিবাদের নামে সমিতি, অ্যাসোসিয়েশান, ব্যাংক, বীমা প্রভৃতির শোষণের বিষ দাঁতকে চুরমার করে দিতে চান। পলিমাটির এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষের দুনিয়ার কথা তাই উদ্ভাসিত হয় তার খরা সনেটগুচ্ছের ৪ নং সনেটে।
গ্রামীণ ব্যাংকের চালে উড়ে এসে বসেছে হুতুম
রৌদ্রঝরা দিন শেষে ধেয়ে আসে মরুর রজনী,
———————————-
শেয়ালের হাসি শোনো, কুমিরের বংশ বুঝি শেষ
সামন্ত নিকেশ করে বাংলাদেশে পুঁজির প্রবেশ।
সুদ নামক মহামারী থেকে মানবতার মুক্তি আজ সময়ের দাবি। কিন্ত ভেনিসের সেই সুদী কারবারীর মতো বর্তমান সুদের কারবারীরা সরাসরি সাইলকের মতো গোশত কাটে না তবে প্রাণ বায়ু বের করে নেয়।
আল মাহমুদ এখানে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্যাংকের প্রতীকী হিসেবে উপমা বয়ান করে সুদের দু’ধারা করাতের বর্ণনা দিয়েছেন। নিঃস্ব জনসাধারণকে পুঁজির লোভ দেখিয়ে সর্বস্ব লুটের পাঁয়তারা বর্তমান ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পগুলো।
রাতের আঁধারে চোর আর শেয়ালের মত পুঁজির পাণ্ডারাও হানা দেয় বিধবার টিনের চালে। সমাজের আবর্তনে সামন্ত ব্যবস্থা শেষ হয়েছে বটে, তবে পুঁজিবাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে জনতা।
পরিশেষে বলা চলে আল মাহমুদ আজীবন সংগ্রামী এক বীর সংগ্রাম করেছেন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, সংগ্রাম করেছেন অসততার বিরুদ্ধে, সংগ্রাম করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, সংগ্রাম করছেন নাস্তিকতার অসাড় আড়ম্বরের বিরুদ্ধে। গেড়েছেন বিশ্বাসের মজবুত ভিত। তাঁর সম্পর্কে কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার একবার বলেছিলেন– লোকেরা বলে আমি নাকি আল মাহমুদের কবিতার নকল করি। তবে একথা সত্য যে সারা জীবনে যদি আল মাহমুদের মতো একটি কবিতাও লিখতে পারতাম তাহলে আমার জীবন সার্থক হয়ে যেত; আমি এও জানি আল মাহমুদ বুঝে গেছেন সামনে সব মতবাদের দিন শেষ এবং একমাত্র জীবনাদর্শ ইসলামেরই বিজয় কেতন উড়বে, তাইতো তিনি তল্পিতল্পা গুছিয়ে ইসলামের প্রাসাদে ঠাঁই নিয়েছেন।
লেখক: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ‘সাহিত্যের কাগজ কাঞ্চী’, নির্বাহী সম্পাদক; লিটল ম্যাগাজিন ‘নোঙর’