আলো দেখো এবং আলো দেখাও

(একজন চির তরুণ এসএমআই স্যার স্মরণে)

মাসুম খান | শুক্রবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

তাঁর ছাত্রছাত্রী, তথা আমার মতো যারা তাঁকে যদিও সরাসরি শিক্ষক হিসাবে পাই নি, কিন্তু ইংরেজির ছাত্র হিসাবে, এবং পরবর্তীতে দেশের একটি ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতার সুবাদে বিশেষজ্ঞঅধ্যাপক হিসাবে কাছে গিয়াছি, সবার কাছে তিনি ‘এসএমআই’ বা ‘মনজুর স্যার’ নামে পরিচিত।

স্যারের অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকে আশংকার মাঝে ছিলাম। এসএমআই এর কথা ভাবলে মনে একজন চিরতরুণ, হাস্যোজ্জ্বল মানুষের কথাই মনে আসে; তাঁর সাথে হাসপাতালের শয্যায় নানানরকম যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত মানুষটাকে মেলাতে পারছিলাম না। শুক্রবার কাজ থেকে বেরিয়ে খবর পেলাম মনজুর স্যারের চলে যাওয়ার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, কৃতি শিক্ষক, বাংলা সাহিত্যের এক চমৎকার গল্পকার, শিল্প ও সাহিত্য সমালোচক, শিল্পবোদ্ধা এবং আরো অনেক কীর্তিমান কাজের স্রষ্টার এক সফল জীবনের সমাপ্তি ঘটলো।

এটি একটি ব্যক্তিগত লেখা, ব্যক্তি এসএমআইকে যেভাবে আমি আমার জীবনে পেয়েছি, তার একটি স্মৃতিচারণ মাত্র। আজ যখন তাঁর কথা ভাবি, মনে হয় আমার জীবনের অনেক সন্ধিক্ষণ বা বাঁক নেয়ার মুহূর্তে স্যারের ছায়া বা ছোঁয়া আছে। প্রথম পরিচয় তো অবশ্যই উনার শিক্ষক ও লেখক পরিচয় থেকেই, একলব্যের মতো দূর থেকে গুরু হিসাবে মানি। ১৯৮৮/৮৯ সাল, ক্যাডেট কলেজের বাঁধা গন্ডী থেকে বেরিয়েছি, ঢাকা গেলে বন্ধুদের বাড়িতে, পথেঘাটে হেঁটে বেড়াই। লালমাটিয়া, সাতমসজিদ রোড এলাকায় ২/৩ জন বন্ধুর বাসা থাকায় সেখানকার রাস্তায় বেশি চলাচল। আমাদের এক বন্ধু তখন ঢাবি ইংরেজিতে ভর্তি হয়েছে, সেই জানালো মনজুর স্যারের বাড়ি কোনটা। এক বিকালে তাঁর সামনে দিয়ে হাঁটছি, স্যার গাড়ি বের করছেন পিছন দিয়ে। মফস্বলের আদমি আমি, উনার গাড়ির তলায় পড়তে যাচ্ছিলাম বেঘোরে থাকায়। তার কিছুদিন পরে আমি তখন চবির ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। আমার বিভাগের শিক্ষকদের সাথে এসএমআই স্যারকে দেখলাম, প্রথম বর্ষের ছাত্র আমাকে স্যার একটি স্বভাবসুলভ হাসি দিলেন। তার কিছুদিন পর, চবি তখন মাসের পর মাস ঘনঘন বন্ধ থাকে, সেখানে পড়াটার উপরে বিতৃষ্ণা চলে আসলো। তখন ভাবলাম ঢাবিতে বদলী নিতে পারি কিনা। সেখাকার ইংরেজি বিভাগের সভাপতির অফিসে গিয়ে দেখি মনজুরুল ইসলাম স্যার চেয়ারে বসা। দুএক কথা বলে চলে আসলাম। বদলি বা মাইগ্রেশন সম্ভব ছিলো না, উনাকে শিক্ষক হিসাবে পাওয়া হলো না।

আরো কয়েকটা বছর পার হলো, ১৯৯৯ সালে শা.বিতে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে এসএমআই বিশেষজ্ঞসদস্য। আমি একজন প্রার্থী: “শেক্সপিয়ারের কোন নাটক তোমার ভালো লাগে?” উত্তর দেয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যামলেটকে কেন ভালো লাগে?” জবাব শুনে স্বভাবসুলভ মাথা নাড়ালেন। “মাষ্টার্সের ফল অনার্সের মতো হলো না কেন?” পরে মনে করিয়ে দিলেন শিক্ষকতায় তথা পড়াশুনায় সর্বদা ভালো মান বজায় রাখার আব্যশকতার কথা।

শাবির শিক্ষকতার কালে এসএমআই স্যারের সাথে কাছে থেকে মেশার সুযোগ মিললো। আমাদের নতুন বিভাগে স্যার নানান কাজে আসেন। সিলেবাস মিটিংএ বসে উনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়। মিটিং শেষে আমাদের সাথে মেশেন সহকর্মী, বন্ধুবৎসল মানুষ হিসাবে। তিনি ইংরেজির নামী অধ্যাপক, আমরা তখন নতুন প্রভাষক: কিন্তু গল্পে কোনোরকম কমতি নেই: স্নেহউপদেশ, ঠাট্টামশকরায় আমাদের সেইসব দুপুরগুলো আজও সমুজ্জ্বল। সবাইকে কাছে টেনে নেয়ার একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিলো স্যারের। আমাদের এক সহকর্মী, তরুণতুর্কী, স্যার তাকে বন্ধুর মতো বরণ করে নিয়েছেন, তাঁর মোটর সাইকেলের পিছনে বসে নিজের বেড়ে উঠার শহরে ঘুরে বেড়ান। সেই সহকর্মীর নববধূকে দেখতে, শুভাশিষ জানাতে স্যার কোনো কার্পণ্য করেন না, তার বাসায় গিয়ে। আমার জন্য একটি স্মরণীয় তথা বিব্রতকর মুহূর্ত হলো এরকম: আমাদের বিভাগের কাজে এসএমআই সিলেট এসেছেন, বললাম ‘রাতের খাবারটা আমার বাসায় খাবেন’। খাবার খেয়ে আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে কিছু খোশগল্প করে রাতে উনাকে উনার থাকার জায়গায় রেখে আসলাম। সাব্যস্ত হলো সকালে উনাকে নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। তো স্যারকে সকালে গাড়িতে তুলে রওনা দেওয়ার একটু পর পুরাতন গাড়িটা বিগড়ে গেলো। উনি বলেন, ‘মাসুম, তুমি দেখো গাড়ি সচল করতে পারো কিনা, আমি ঠেলছি!” এই বলে মনজুর স্যার একা গাড়ি ঠেলতে শুরু করলেন। এমনই মানুষ ছিলেন মনজুরুল ইসলাম স্যার! সে যাত্রায় অবশ্য বিকল্প যানে আমরা দু’জন বিভাগে গেলাম।

শাবিছাড়ার পরেও হয় ঢা.বি.-র লাইব্রেরির সামনে, বা উনার নিজের বিভাগে আমাদের দেখা হয়েছে। প্রত্যেকবারই নিজে থেকেই, হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, “কেমন আছো, কেমন চলছে?” আব্বার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে লম্বা সফরশেষে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেছি, দেখি স্যারও সিলেট যাচ্ছেন। সব শুনে সমবেদনা জানালেন, আবার দেখা হবে বলে বিদায় নিলেন। এরপর আরো দু’বার দেখা। সিলেটে আমার তখনকার সাময়িক কর্মোস্থলে উত্তরআধুনিকতা নিয়ে একটি বক্তব্য দিলেন। জটিল বিষয়টাকে সহজ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন, তাঁর প্রতিভার দীপ্তিতে আবারো বিস্মিত হলাম। বক্তব্য শেষ করে চলে যাওয়ার সময়, দ্বিতীয় সারিতে বসা আমাকে দেখে বললেন, “আরে, তুমিও এসেছো!” শেষবার দেখা উনার বিভাগের অফিসে, ব্যস্ততার মাঝেও সম্ভাষণ জানাতে ভুল করলেন না।

আমরা যারা ইংরেজি পড়েছি, পড়িয়েছি, বা পড়াই তাঁদের কাছে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন অভিভাবক, পথপ্রদর্শক আলোকবর্তিকা স্বরূপ। স্যারের চলে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে আমদের একজন বাতিঘর নিভে গেলো, খবরটা পেয়ে গতকাল থেকে মনটা এসএমআইময় হয়ে আছে।

মনজুর স্যারের “অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প” তখন নতুন কিনেছি। শাবিতে স্যারকে কাছে পেয়ে বলেছিলাম স্বাক্ষর করে দিতে। নাম সই করার সাথে দু’লাইন লিখে দিয়েছিলেন: “মাসুম, আলো দেখো এবং আলো দেখাও।”

১১ অক্টোবর ২০২৫ (মাসুম খান: ইংরেজি প্রভাষক, নিউহাম কলেজ, লন্ডন)

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাইশে অক্টোবর
পরবর্তী নিবন্ধময়ুখ চৌধুরী এবং ৩২ দক্ষিণ নালাপাড়ার ড্রইংরুমের ছাত্র