পরিপূর্ণ নিয়ন আলোতেও যে এক আঁধার–কালো অমানিশা ঘনিয়ে আসে, তা কি আমরা বুঝতে পারি? হয়ত পারি বা হয়তো পারি না। আলোয় আলোয় ভুবন ভরা, কিন্তু রাতের কৃত্রিম আলোর চোখ ধাঁধানো রূপের ভিতরেও যে আমাদের জীবন সংহারের উপকরণ রয়েছে। তা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। তাই তো নোবেল জয়ী বিখ্যাত বিজ্ঞানী, কবি ও নাট্যকার ‘রোয়াল্ড হফম্যান’একবার এক বৈজ্ঞানিক বৈঠকে আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘রাতের আঁধারের গহীন হতে ঠিকরে পড়া আলো আমার হৃদয় হরণ করে বটে, কিন্তু তাঁর অন্তর্নিহিত বিষে আমার পৃথিবী ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে’। নিঃসন্দেহে বলা যায় কৃত্রিম আলো আবিষ্কার এই পৃথিবীতে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার বটে। একটি সুইচে চাপ দিয়েই অন্ধকার দূর করে আলো দিয়ে ঘর ভরিয়ে তোলা যায়। ধরণীর বুক থেকে সূর্য ডুবে গেলেও কাজ করা নিয়ে ভাবতে হয় না এখন। এই ঝলমলে উজ্জ্বল আলোর যদি কোনো অন্ধকার দিক থাকে তবে সেটি হচ্ছে রাতের নিজস্ব আলোকে কেড়ে নেওয়া। পরিবেশে যত বেশি আলো আমরা যুক্ত করছি, তত ক্ষতি হচ্ছে পৃথিবীর ইকো সিস্টেমের। কারণ প্রাণীদের জীবনচক্র নির্ভর করে অন্ধকারের উপর। প্রাকৃতিক আলোতে ছন্দ পরিবর্তন করায় বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনধারা। অন্যভাবে চিন্তা করলে শুধু প্রাণীরাই নয়, আমরাও রাতের আঁধারের সঙ্গে সংযুক্তি হারিয়ে ফেলেছি। রাতের অন্ধকারে দাদা–নানিদের কাছ থেকে গল্প শোনার সেই পরিবেশ আর নেই, বদলেছে ফসল বোনা আর চাষের সময়ও। আমেরিকার টাকসনের ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক–স্কাই অ্যাসোসিয়েশনের আমান্ডা গর্মলি বলেন, ‘বিশ্ব খুব দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই সঙ্গে রাতের অন্ধকারও কমছে। অন্ধকার হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের নিজেদেরও হারিয়ে ফেলেছি। সন্ধ্যার পর রাতের আঁধারের যে নিস্তব্ধতা সেই অনুভূতি অনুভব করার ক্ষমতাও কমে আসছে’। আলো এখন আবিষ্কার হিসেবে উপকারী নয়, হয়ে উঠেছে ক্ষতিকর।
উনিশ শতকে উদ্ভাবিত ইলেকট্রিক লাইট নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী বিপ্লব। বর্তমানে এই আলো ছাড়া জীবন চিন্তাও করা যায় না। তবু এখনো বিশ্বের ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দূষিত আলোর মধ্যে বাস করে। যেমন:-সিঙ্গাপুরে রাতের আলো এত বেশি উজ্জ্বল যে সেখানকার মানুষের রাতের সত্যিকার অন্ধকারে চোখ মেলতেই সমস্যা হয়। আসল আলোতে তারা এখন আর খাপ খাওয়াতে পারে না।
বড় বড় শহরে বাস করা মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে কৃত্রিম আলোর কারণে। ভারতের জনবহুল শহর মুম্বাইয়ে আলো দূষণ নিয়ে কাজ করছেন আইটি ওয়ার্কার নিলেশ দেশাই। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে বিষয়টি খুব চিন্তার। একরকম ভয়াবহ। পুরো মুম্বাইয়ে এখন শুধু কমলা আলোর ঝলকানি দেখা যায়। রাত ১২ টা তো প্রতিদিনই, রাত ৩ টার সময়ও এ আলো কমে না। বিশেষ করে আলোকিত বিলবোর্ড, ফ্লাডলাইট ও স্ট্রিটল্যাম্পগুলো। ইদানীং আলোর ঝলকানি যেন আরও বেড়ে গেছে। দিন দিন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি’।
কৃত্রিম আলোর সঙ্গে চোখের ক্ষতি, নিদ্রাহীনতা, ওবেসিটি এমনকি ডিপ্রেশনেরও সংযোগ আছে বলে জানা গেছে গবেষণায়। ২০০৭ সালে আমেরিকার একটি গবেষণায় শিফট ওয়ার্কারদের সঙ্গে সংযোগ পাওয়া গেছে ব্রেস্ট ক্যানসারেরও এ রোগটি পুরোটাই জড়িত মেলাটোনিন হরমোনের সঙ্গে, যেটি নিঃসৃত হয় অন্ধকারে। চোখের রেটিনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, নিউরন সেই সিগন্যাল পৌঁছানোর কাজ করে আলো। এই পদ্ধতিতেই তৈরি হয় মেলাটোনিন হরমোন। মেলাটোনিন যেহেতু সন্ধ্যার পর তৈরি হয় এবং মধ্যরাতে ঘুমের সময় জেগে থাকায় পুরো সময়ের চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, শরীরের তাপমাত্রা কমায়, মেটাবোলিজম ধীর করে এবং লেপটিন বাড়িয়ে দেয়, এমনকি ক্ষুধাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। কম্পিউটার স্ক্রীন, উজ্জ্বল বাথরুমের আলো অথবা আমাদের জানালায়–ঘরের ভিতরে –বাইরে রাস্তায় আলো পড়া সবই আমাদের শরীরের স্বাভাবিক মেলাটোনিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। লেপটিনের কমতির কারণে রাতের শারীরিক চক্রে ব্যাঘাত হওয়ায় দেখা দিতে পারে ওবেসিটি। বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার কাইবা আরও বলেন, ‘আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে অথবা শিফটে কাজ করেন এমন কর্মীরা যখন অতিরিক্ত আলোর মধ্যে থাকেন তখন তাদের শরীরে মেলাটোনিন হরমোন তৈরি হয় না। শরীরের যে বায়োলজিক্যাল ক্লক(ঘড়ি) আছে সেটি সময়মতো কাজ করতে পারে না। আর এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ’।
বছরের পর বছর ধরে মানবদেহে কাজ করে আসছে সময়। রাতের বেলা ঘুম, দিনের বেলা জেগে কাজ করা এটাই স্বাস্থ্যসম্মত। এ নিয়মের বাইরে চলাচল করলে একসময় শরীর খারাপ করবেই। আমেরিকার কানেকটিকাট ইউনিভার্সিটির মহামারীবিদ রিচার্ড স্টিভেনস গবেষেণা করছেন আলো দূষণ ও মানবদেহের ওপর তার প্রভাব নিয়ে। তাঁর মতে, ‘রাতের বেলা শরীর কাজ করে অন্ধকারে। এটি যে শুধু ঘুমের ওপর নির্ভরশীল তা নয়। শরীরের জন্য আসলে রাতের দীর্ঘ সময়ের অন্ধকারও সুস্থ থাকার একটি অংশ’।
শুধু যে মানুষের জন্যই প্রাকৃতিক দিন–রাতের আলো প্রয়োজন তা নয়। যে প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য রাতের আলো জরুরি তাদের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে এ আলোর কারণে। যেমন কোরাল স্বাভাবিক নিয়মে পুনর্গঠিত হয় না, অভিবাসী পাখিদের সময় দ্বিধা তৈরি হয়, সদ্য জন্ম দেওয়া কচ্ছপরা সমুদ্রের দিকে যাওয়ার বদলে রাস্তায় চলে আসে আর মারা যায়। লিবনিজ ‘ইনস্টিটিউট ফর ফ্রেশওয়াটার ইকোলজি অ্যান্ড ইনল্যান্ড ফিশারিজ’–এর বিজ্ঞানী সাইবেল স্ক্রোবার বলেন, ‘রাতের বেলা এমন উজ্জ্বল পরিবর্তনের প্রাণিজগতের পরিবর্তন খুব বেশি চোখে পড়ছে। দিন ও রাতের পার্থক্য হারিয়ে ফেলছে তারা। পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্যের এমন পরিবর্তন ভালো কিছুর সম্ভাবনা দেখাচ্ছে না।বরং সবার জন্যই বিষয়টি শঙ্কাজনক’।
প্রাণীদের পাশাপাশি মানুষের জন্য উপকারী পোকামাকড়ও আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষণা মতে, জার্মানিতে প্রতি গ্রীস্মে ১০০ বিলিয়নের বেশি পোকা মারা যায় শুধু কৃত্রিম আলোর কারণে। সাধারণত চাঁদের আলোর উপর নির্ভর করেই পোকারা চলাচল করে, কিন্তু সড়ক বা মহসড়কের নিয়ন লাইটের প্রখর আলেতে দিগভ্রান্ত হয়ে এ আলোর চারপাশেই তাদের চলাচল বাড়তে থাকে। পুরো রাত আলোর আশপাশে ঘোরার কারণে ও অতিরিক্ত তাপের কারণে তারা ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে, গর্ভধারণের ক্ষমতা হারায়, অন্য শিকারি পোকা বা প্রাণীদের হাতে দ্রুত ধরা পড়ে। ক্ষতিকর প্রভাব আরও পড়ে বাদুর, মাছ, পানির নিচের অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের ওপরও।
প্রাণী ছাড়াও, উদ্ভিদের বেলাতেও বিষয়টি শংকার। আলোর কারণে প্রভাব পড়ে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য লাগানো গাছের ওপরও। ২০১৬ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সড়কের নিয়ন বাতির কাছাকাছি যেসব গাছ লাগনো হয় সেগুলো সারারাত আলো দূষণে এতটা আক্রান্ত হয় যে, ধীরে ধীরে ফল ধরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। গাছেরাও রাতের আঁধারের প্রভাব বুঝতে পারে। কখনো হয়তো সময়ের আগেই তাদের বিকাশ হয়, আবার কখনো সময়ের অনেক আগে গাছের পাতা ঝরে যায়। বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ এখনো বিদ্যুৎ পাওয়ার মূল উৎস। রাতের বেলা অপ্রয়োজনীয় আলো ব্যবহার করা তাই বায়ুদূষণ ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য দায়ী। ভারতের উত্তর প্রদেশের রানী লক্ষ্মীবাই সেন্ট্রাল অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত বিজ্ঞানী ‘পাবন কুমার’–এর মতে, ‘প্রতিবছর অতিরিক্ত আলোর কারণে পরিবেশে ১২ মিলিয়ন টন কার্বন–ডাইঅক্সাইড নিঃসৃত হয়। আলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং নগর পরিকল্পনা করা হলেই এই আলো দূষণ কমানো সম্ভব। সঙ্গে আলোর উৎস এবং অর্থও বাঁচানো যাবে’। এসব বিষয় নিয়ে যতটুকু কাজ করা দরকার সেই প্রক্রিয়া খুব ধীর। ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়া অবশ্য এদিক থেকো কিছুটা এগিয়ে। ইকো–সেনসেটিভ এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত আলো জ্বালালে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এমন পদ্ধতি চালু করেছে তারা।ফ্রান্সের কিছু জনবহুল এলাকায় নির্দিষ্ট একটি সময়ের পর আলো বন্ধ করে দেওয়ার নিয়ম জারি করা আছে। ভারত এবং ইন্দোনেশিয়ায়ও এমন কিছু নিয়ম জারি করার কথা ভাবা হচ্ছে।
পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য দিন ও রাত দুই সময়ই জরুরি। তাই তো গীতিকারের ভাষায় বলতে চাই,‘জোনাকির নাম নাকি আঁধার মানিক, আমি তো দেখি আগুন জ্বলে ধিকি ধিকি’। জোনাকির মতো উপকারী পোকাও তীব্র আলোর প্রভাবে ইকো সিস্টেম থেকে হারিয়ে যাওয়ার মানে দাঁড়ায় আলোর মিছিলে আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি। সর্বনাশ হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। তাই আমাদের দেশকেও ভাবতে হবে কৃত্রিম আলোর দূষণ থেকে মানুষকে কীভাবে বাঁচানো যায়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট