আলোকিত মানুষ রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক

এস.এম. মোখলেসুর রহমান | শুক্রবার , ১৪ জুলাই, ২০২৩ at ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ

কিছু কিছু মানুষ আছে সমাজে দ্যুতির মতো আলো ছড়ায়। অন্ধকার তাদের ঢেকে রাখতে পারে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক হলেন সেরকম একজন দ্যুতিমান মানুষ। যিনি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তিত্ব। এক কথায় চিত্ত এবং বিত্তের সমন্বয়ে আলোকিত মানুষ রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। দেশে এরকম রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক হয়তো আরো অনেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক দেশের মধ্যে একজনই। কারণ তিনি বাঙালি জাতির ইতিহাসের অংশ। জনশ্রুতি আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছেন তিনি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু নামের রূপকার রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান কারাগারে ছিলেন তখন ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য বুলেটিন প্রকাশ করতেন। সেই বুলেটিনের নভেম্বরের সংখ্যায় ‘আজব দেশ’ শিরোনাম প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে বঙ্গবন্ধু শব্দটি জুড়ে দেন তখনকার তুখোড় ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। তিনি ‘সারথী’ ছদ্মনামে এই ‘আজব দেশ’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধিটির ঘোষণা দেন তখনকার ডাকসু’র ভিপি বর্তমানে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জননেতা তোফায়েল আহমেদ। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেই অনুষ্ঠানে লাখ লাখ জনতার সামনে জননেতা তোফায়েল আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে বঙ্গবন্ধু নামটি বাংলার আনাচেকানাচে থেকে শুরু করে বহি:বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আপামর জনতা এক নামে বঙ্গবন্ধু হিসেবেই চিনতে শুরু করেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু নামটি ব্যাপক জনপ্রিয়।

সেই বঙ্গবন্ধু নামের রূপকার রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের জন্ম ১৯৫০ সালের ১১ আগস্ট চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার পরৈকোড়া ইউনিয়নের ভিংরোল গ্রামে। পিতা মরহুম নুরুল হক চৌধুরী, মাতা: মরহুমা মুসলিম আরা। জন্ম গ্রামে হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম শহরে। পড়তেন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। এই স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মেট্রিক তথা এসএসসি পাশ করার পর তিনি চলে যান ঢাকা শহরে। ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে। এখানেই তিনি সহপাঠী হিসেবে পান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ কামালকে। এখানেই তিনি ছাত্র রাজনীতিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। যদিও রাজনীতির হাতেখড়ি স্কুল জীবনে। তবে ঢাকা কলেজে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে পরিচিতি পান বেশি। স্কুলে তিনি মুসলিম হাই স্কুল ছাত্রলীগ এবং চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ’৬৯ এর গণআন্দোলনের সময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমাদের চট্টগ্রামের গৌরব মুশতাক ভাই। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও অংশ নেন তখনকার তরুণ ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহসভাপতি ছিলেন এবং একই বছর তিনি অনার্সও সম্পন্ন করেন। ১৯৭৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।

মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক পড়ালেখা শেষ করে ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। গড়ে তোলেন নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কেএন হারবার কনসোর্টিয়াম। ব্যবসায়িকভাবেও তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। দানবীর মানুষ রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ঢাকায় বসবাস করলেও তাঁর মন পড়ে থাকতো চট্টগ্রামে। নিজের জন্মস্থান চট্টগ্রামকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাই তো ঢাকা শহরে কোনো চট্টগ্রামবাসী বিপদে পড়ে উনার কাছে গেলে তিনি সহজে কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না বলে জানা যায়। আন্তরিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। উনাকে বলা হতো অসহায় মানুষদের শেষ আশ্রয়স্থল। ঢাকা শহরের তোপখানা রোডে চট্টগ্রাম সমিতির যে সুউচ্চ বিল্ডিং আছে, সেটা গড়ে উঠার পেছনেও রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ভাইয়ের বড় অবদান আছে। তিনি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির তিনবার সাধারণ সম্পাদক এবং একবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই চট্টগ্রাম সমিতির অফিসেই মুশতাক ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয় এবং খোলামেলা অনেক আলোচনা হয়। চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’ বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত একুশের বইমেলা চলাকালীন সময়ে ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির অফিসে ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ’ শিশুসাহিত্য পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান করে আসছেন। আমিও কয়েকবার গিয়েছি সেই অনুষ্ঠানে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের অনুষ্ঠানে গিয়ে পেয়েছি রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ভাইকে। সেইদিন শুনেছি উনার বক্তব্য, সেইদিন শুনেছি চট্টগ্রামের প্রতি উনার ভালোবাসার গল্প সহ নানান অজানা তথ্য।

মুশতাক ভাই চট্টগ্রাম একাডেমিরও একজন জীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মাশিশু ও জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি, ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকাস্থ আনোয়ারা সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন সহ আরো বিভিন্ন সংগঠনের আজীবন সদস্য, পৃষ্টপোষক সদস্য এবং উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও জড়িত ছিলেন। মূলত তিনি একজন দক্ষ সংগঠক এবং সমাজসেবকও। ছাত্র রাজনীতির পর তিনি আর মূল ধারার রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও সামাজিক সংগঠন এবং জনসেবামূলক কাজ করে গেছেন আমৃত্যু।তিনি সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন স্বাধীন বাংলা ফাউন্ডেশন এবং গ্রামীণ মেধা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। অন্যদিকে নিজ জন্মভূমি আনোয়ারাতে তিনি গরীব অসহায় ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তাঁর বাবামায়ের নামে ‘নুরুল হকমুসলিম আরা মেমোরিয়াল ট্রাস্টফান্ড’ ও গঠন করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ সরব ছিলেন। প্রায় সময়ে নানান বিষয়ে স্ট্যাটাস দিতেন তিনি। মৃত্যুর একদিন পূর্বে ১৪ জুলাই ২০২১ তারিখেও চট্টগ্রামের সিআরবি নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। শিরোনাম দিয়েছিলেন– ‘বাঁচাও শিরীষতলা, সিআরবি, চট্টগ্রাম: হউক প্রতিবাদ’। কিন্তু দু:খের বিষয় ১৪ তারিখ দিবাগত রাতেই ম্যাসিভ হার্টএ্যাটাক হয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রেখে যান পেছনে বিশাল স্মৃতি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। স্ত্রী নাজনীন চৌধুরী, বড় মেয়ে মাহজাবিন রেজা, ছোট মেয়ে আনিকা রেজা এবং একমাত্র পুত্র সাদিদ রেজা চৌধুরী ও নাতি নাতনীন সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান পরোপকারী মুশতাক ভাই। আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম একাডেমি বিকেল সোয়া ৫টায় এক স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। আমরা মুশতাক ভাইয়ের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা