চট্টগ্রামের আনোয়ারায় সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া লেখক জিনাত আজম সাহিত্যাঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। ছোটগল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি ও রম্যরচনায় তিনি ছিলেন অধিক স্বতঃস্ফূর্ত ও সচ্ছন্দ। চট্টগ্রাম একাডেমির জীবন সদস্য ছিলেন তিনি। একজন নিভৃতচারী সমাজসেবী ও নিষ্ঠাবান সংগঠক জিনাত আজম চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবে ৬ বছর সাধারণ সম্পাদক ১৫ বছর সম্পাদক এবং ২৪ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ইনার হুইল ক্লাব আগ্রাবাদের সভাপতি ছিলেন। ছিলেন ‘নারীকন্ঠ‘ পত্রিকার সম্মানিত উপদেষ্টা। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চমেক রোগী কল্যাণ সমিতি, চক্ষু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম প্রগ্রেসিভ ট্রাস্ট, মহিলা ইসলামী পাঠাগারের প্রাক্তন সম্পাদিকাসহ বহু প্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। লেখালেখি ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি অনেক সংগঠন থেকে সম্মানিত হয়েছেন, পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। বিভাগীয় সমাজ কল্যাণ সংস্থার ‘সমাজসেবা স্বর্ণপদক’, ‘মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বর্ণপদক’, ‘রত্নগর্ভা মা স্বর্ণপদক’, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব ও চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ সম্মাননাসহ বেশ কিছু পদকে ভূষিত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের ৬৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। কলেজের এক্স স্টুডেন্ট পরিষদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে যেকোনো মিটিংয়ে তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম। হাস্যোজ্জ্বল মুখে মিষ্টি হেসে বলতেন, এই কলেজেই কেটেছে আমার ‘মেয়েবেলা’। ২০২৩ এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পুনর্মিলনীর আহ্বায়ক ছিলেন, প্রতিটা প্রস্তুতিমূলক সভায় সময়মতো উপস্থিত থাকতেন। আমরা কলেজের সবাই সিনিয়রদেরকে আপু/আপা সম্বোধন করলেও উনি এতোটাই সিনিয়র ছিলেন যে উনাকে আপু কিংবা আপা বলতে পারতাম না।
আমার জানামতে তিনি ছিলেন মোস্ট সিনিয়র একজন যিনি সর্বোচ্চ আনন্দ–উচ্ছ্বলতার মধ্যদিয়ে কলেজের অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করতেন। চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘে ১৫ বছর সুষ্ঠুভাবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন শেষে সভাপতি মনোনীত হয়েছেন গত বছরের মার্চ মাসে। প্রত্যেক মাসের নিয়মিত সভায় উপস্থিত হতেন নির্দিষ্ট সময়েরও আগে। সংঘের সবকাজ নিজহাতে সামলাতেন। প্রত্যেকটা সভার নির্দিষ্ট তারিখের আগে সংঘের প্রত্যেক সদস্যকে নিজেই ফোন করতেন। দেশের ক্রান্তিকালে সভাপতি মনোনীত হলেও খুব কম সময়ের মধ্যেই তাঁর নিজের সম্পাদনায় সংঘের ম্যাগাজিন ‘পূর্বিতা’ প্রকাশ করেছেন। এর আগেও সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে অনেকগুলো ‘পূর্বিতা’ সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। তাঁর আন্তরিকতা এবং তৎপরতায় অনেক সদস্য অন্তর্ভুক্তি হয়েছে চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘে। ১৯ শে এপ্রিল ২০২৫–এ সংঘের উদ্যোগে ‘চার গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব’ অনুষ্ঠানটি তাঁর দক্ষ পরিচালনায় সম্পন্ন করেছেন অত্যন্ত সুচারুরূপে। খুব সুন্দর চমৎকার একটা অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছেন আমাদের। আমাদেরকে হাতে কলমে শিখিয়েছেন কীভাবে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হয়, শিখিয়েছেন কীভাবে অনুষ্ঠানের সফল পরিসমাপ্তি দিতে হয়। সেদিন অনুষ্ঠান শেষে ফটোসেশনের পরেই আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের বিশেষ কিছু দায়িত্বের ব্যাপারে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। পরেরদিন আবার ফোন করে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন অনেক কিছুই। এরপরের মাসেই মে‘র ২৪ তারিখে মাসিক সভার আয়োজন ছিলো। ২৪ তারিখেই ছিলো আমার হজ ফ্লাইট। সংগত কারণেই আমি সভায় উপস্থিত হতে পারবো না। মিটিংয়ের আগে তিনি অবশ্যই ফোন দিবেন, তাই তিনি কল দেওয়ার আগেই আমি কল করে কথা বলেছিলাম উনার সাথে। আমি দোয়া চাইতেই তিনি বললেন, ‘আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। নুসরাত, আমার জন্য দোয়া করো’। সেদিনই তাঁর সাথে শেষ কথা হয় আমার। জুনের ১৫ তারিখে সৌদি আরবের সময় সকাল ৮ টায় আমি আমাদের কাফেলার গ্রুপের সাথে রিয়াদুল জান্নাতে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বেরোনোর জন্যে হোটেলের লবিতে নামলাম। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তখনই ওনার মৃত্যু সংবাদটা দেখে আমি স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গেলাম। স্তম্ভিত হয়ে বসে পড়লাম। গ্রুপের অন্য সদস্যদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাদের সাথে পথ চলছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার মন শুধু পড়ে রইলো উনার সাথে কাটানো সময়গুলোতে। মায়াবী চেহারার সরল হৃদয়ের মানুষটা এভাবে চলে গেলেন! কতোকিছু যে ভেসে এলো আমার স্মৃতিতে। আমি আমার পোষা পাখি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলেই তা দেখে সাথে সাথেই তিনি আমাকে কল করতেন। কীভাবে পাখিদেরকে খাওয়াই কীভাবে যত্ন করি ইত্যাদি খবরা খবর নিতেন। বাগান নিয়ে পোস্ট করেছিলাম। তাতেও তিনি কল করলেন। খবরা খবর নিলেন। মানুষের প্রতি তাঁর যেমন অগাধ ভালোবাসা ছিলো, স্নেহ–মায়া–মমতা ছিলো ঠিক তেমনি গাছের প্রতি, পাখির প্রতিও তাঁর অন্যরকম ভালোবাসা ছিলো। চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের মিটিংয়ে এসেই টেবিলে রাখা ছোট্ট বনসাই গাছটিতে পানি দিতেন বোতল থেকে। আমাদের প্রত্যেকের নজরে এসেছে বিষয়টি। কত শত স্মৃতি ওনার সাথে আমাদের। মিরসরাই আরশিনগর গিয়েছিলাম একসাথে। আমাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলেছিলেন। স্মৃতিগুলোর কল্পনায় আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি রিয়াদুল জান্নাতে পৌঁছেই উনার জন্যে দোয়া করেছি। সেদিন সারাদিন মসজিদে নববীতে কেটেছে আমার সময়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আমি তাঁকে স্মরণ করেছি, তাঁর জন্য দোয়া করেছি। এশার নামাজের পরে নফল নামাজ পড়েও দোয়া করেছি। মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেস্তের উঁচু মাকাম দান করুন, আমিন।
তাঁর স্বামী উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা মরহুম আলী আজম খানের বাড়ি মোহরায়। দুই পুত্র ও এক কন্যার গর্বিত জননী জিনাত আজম ব্যক্তিগত জীবনে একটি সুখী সচ্ছল পরিবারের সুগৃহিণী। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তাঁর বড়ছেলে আতিক খান লিখেন, ‘২০০৩ সালে আব্বা মারা যাওয়ার পর হতেই আম্মা সবসময় দোয়া করতেন, যেন সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায়, হাঁটাচলা করার সময় আল্লাহ উনাকে তুলে নেন আর কারো পরমুখাপেক্ষী হতে না হয়। আম্মা মহিলাদের লাশ ধোয়ার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। মহিলাদের বিভিন্ন দোয়া মাহফিল পরিচালনা করতেন। ১৯৯৬ হতে গ্রামের মহিলাদের নিয়ে ২৯ বছর ধরে প্রতি চন্দ্রমাসে এক খতম করে কুরআন শরীফ পড়তেন। প্রতিদিন পাখীদের খাওয়াতেন, বাসার সামনে পথচারী আর রিকশাওয়ালাদের জন্য পানির জার রাখতেন। আর বহু বছর ধরে এলার্ম দিয়ে তাহাজ্জুদ আর ফজরের নামাজ পড়তেন। এছাড়াও আরো অনেক ধরনের সেবামূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। উনি এত ইবাদত আর আমল করতেন বলেই, আমার ধারণা আল্লাহ উনার দোয়া কবুল করে ঘুমের মধ্যে তুলে নিয়েছেন।’
রম্য সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা বেগম জিনাত আজম একজন সফল লেখক। তাঁর ভ্রমণ কাহিনিগুলোও চমৎকার। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন তিনি ভ্রমণ করেছেন তেমনি ভ্রমণ করেছেন ইংল্যান্ড, জার্মানি, ভারত, ফ্রান্স, কানাডা, সিঙ্গাপুর, নেপাল, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত সহ অনেকগুলো দেশে। ভাই বোনদের সাথে, হাজবেন্ডের সাথে এবং ছেলের সাথে হজ পালন করেছেন তিনবার।
লেখালেখির প্রতি সনিষ্ঠ আন্তরিকতা তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনের দিকে। তাঁর স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘আমি তেলাপোকা বলছি’। এটি রম্য রচনার সংকলন।
সমাজের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি, অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতি তির্যকভাবে রম্যরসের সমন্বয়ে প্রতিফলিত হয়েছে রচনাগুলোতে। ‘অন্য আলোয় অন্য ভুবন’ তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ। ৮টি ছোটগল্পের অনন্য সংকলন এটি। গল্পগুলোতে প্রেম–ভালোবাসা, সংঘাত, দ্বন্দ্ব যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি ফুটে উঠেছে গল্পলেখকের দেশপ্রেম। গল্পগুলো পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। তাঁর ভ্রমণকাহিনি সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘অন্তরে বাইরে অনিকেত প্রান্তরে’ বইটিতে তিনি লন্ডন, জার্মানি ও ফ্রান্স ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য রম্যগ্রন্থ হলো ‘নজর আলীর সাতকাহন’। এই গ্রন্থে লেখক নজর আলীকে নিয়ে ২০টি ছোট গল্প রচনা করেছেন। রম্যরসের মাধ্যমে জীবনের ও সমাজের কতিপয় সমস্যাগুলোকে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে চিহ্নিত করেছেন, সমাজের অসঙ্গতি গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পের ছলে।
রম্যলেখক জিনাত আজম সম্পর্কে অল্প কথায় লিখে শেষ করা যাবে না। ফুল–ফল আর পত্র–পল্লবে ভরা বৃক্ষের ন্যায় সুশোভিত তাঁর জীবন। যার সর্বত্র মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে রয়েছে। সবাইকে তিনি সস্নেহে বুকে টেনে নিতেন। নীরবে ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়া এমন মানুষ সমাজে বিরল। তাঁকে হারিয়ে আমরা হারিয়েছি এমন এক নক্ষত্র যে নক্ষত্রের চারপাশ ভালোবাসার উজ্জ্বলতায় আলোকিত। যে নক্ষত্রের কোনো বিকল্প হয় না।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগঠক।










