‘আপনার জীবনীও তো আলোকিত গুণীজন সাতকানিয়া–লোহাগাড়া গ্রন্থে এসেছে’–এটি শুনেই ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন স্মিত হেসে জবাবে বললেন, ‘তাই নাকি! মোয়াজ্জেম তো সাতকানিয়া–লোহাগাড়ার মনীষী–গুণীদের নিয়ে বেশ ভালো কাজ করছে।’ বইটিতে ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন–কে তুলে ধরা হয়েছে ‘বহুমুখী প্রতিভার এক বিরল প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে। যিনি তুলে ধরেছেন তিনি হলেন আলোকিত গুণীজন সাতকানিয়া লোহাগাড়া নামের জীবনীমূলক গ্রন্থের লেখক মোয়াজ্জেম হোসেন। সাতকানিয়া–লোহাগাড়া মনীষা ছিল লেখককের প্রথম বই। সেই বইয়ে উক্ত এলাকার কিংবদন্তীতুল্য অনেকের সংক্ষিপ্ত জীবনীর চিত্রায়ন দেখেছে। এবার দ্বিতীয় বইয়ে দৃশ্যপটে এই এলাকার লিভিং লিজেন্ডরাও।
লেখক মোয়াজ্জেম হোসেন ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে লেখার হাতকে পোক্ত করেন। ফলে অন্যান্য পরিচয়ের বাইরে এসে ফোকাস পাচ্ছে লেখক সত্তাও।
গ্রন্থের প্রকাশনা উপদেষ্টা হিসেবে আছেন কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ, চট্টগ্রামের একটি শক্তপোক্ত ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি’ গড়ে তোলার জন্য যিনি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে ভালো কিছু হবে এমন অনুমিতই ছিল।
২০০ এর মতো পৃষ্ঠায় ১০০ জনের জীবনী বন্দী করার জন্য বড় হিম্মত থাকতে হয়, সেটিই দারুণভাবে দেখিয়েছেন লেখক। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্য হতে ১০০ জন গুণীজন বাছাই করে তাদের জীবনী সংগ্রহ করা দুরূহ কাজ।’ বিভিন্ন স্মারকগ্রন্থ, প্রকাশনা, পত্র–পত্রিকা, এমনকি বক্তব্যে থেকে সহায়ক হিসেবে তথ্য নেয়া হয়েছে। তবে বেশিরভাগ তথ্য–উপাত্ত এসেছে সরাসরি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, যা কঠোর পরিশ্রমের বিপরীতে পাওয়া যায়। যার জন্য ‘শনিবার, রবিবার, পরিবার’ ভুলে কাজ করতে হয়। তাই বইয়ের উৎসর্গ পত্র লেখকের স্ত্রী দিনা, পুত্র নাভান, আয়ান এবং কন্যা আনাবিয়া বরাবর প্রেরণ করাটাই স্বাভাবিক।
ঐতিহ্যবাহী শৈলী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটির ৪০০ টাকা দাম রাখাটা বাজারসই বলা যায়।এই গ্রন্থের সূচি বয়োজ্যেষ্ঠ থেকে বয়োকনিষ্ঠভাবে সাজানো হয়েছে। কাউকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সাজানো হয়নি। এখানে লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিলেন।
এবার আসি আলোকিত মানুষ–এর সংজ্ঞায়। লেখকের মতে, ‘যে মানুষদের মহৎ চিন্তার বাস্তবায়নে সমাজের উন্নয়ন হচ্ছে, মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তন আসছে, সর্বোপরি দেশের উন্নয়ন হচ্ছে তারাই আলোকিত গুণীজন।’ কিন্তু যার উপর আলো পড়েছে সেই কিন্তু এখানে আলোকিত। এই আলোকায়নের বাইরেও তো কোন অসাধারণ জীবনী থাকতে পারে। প্রশ্নের উত্তর বইয়ের মধ্যে দিয়ে আগেভাগেই দায়মোচন সেরে ফেলেছেন লেখক। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক আলোকিত ব্যক্তি আছেন, যারা নিজেকে লোক চক্ষুর আড়ালে রাখেন এবং নিজের যশ–খ্যাতি অন্য কাউকে জানতে দিতে চান না, এমন অনেক মনীষীর জীবনী এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করতে পারিনি। আবার এমন অনেকে আছেন, যাদের কৃতি, যশ ও খ্যাতির খবর আমাদের দৃষ্টির অগোচরে রয়েছে, স্বাভাবিকভাবে তাদের জীবনী এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়নি।’
সবচেয়ে ভালো লেগেছে, বইতে শুধু গতানুগতিক তথ্য নয়, আরো অনেক মোটিভেশনাল বিষয় তুলে আনা হয়েছ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখান থেকে অনেক কিছু চিনবে, জানবে, জিজ্ঞাসার জবাবও পাবে।
বইয়ের শুরুটা রামপুরের অধিবাসী প্রকৌশলী এ এ এম জিয়া হোসাইনকে দিয়ে। যাকে বলা যায় ফাদার অব দ্যা ইঞ্জিনিয়ার্স। কাঞ্চনাবাসী জাতীয় অধ্যাপক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনও আছেন স্বমহিমায়। কিন্তু সারাদেশ পড়ছে যার বই, সেই অণু, পরমাণু, ইলেকট্রন, প্রোটন নিয়ে বই লেখা অধ্যাপক হারাধন নাগ যে সাতকানিয়ার কাঞ্চনার মানুষ তা কি বইটি না পড়লে জানা যেতো! সুখছড়িবাসী বিজ্ঞান লেখক তপন চক্রবর্তীর সাথেও পরিচয় হবে এখানে। ১৯৭০ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ডক্টরেক্ট সম্পন্ন করা কাঞ্চনার ড. খালিকুজ্জামানকেও চিনে নেয়া যাবে।
বইয়ে উদ্ভাসিত জীবনী থেকে জানতে পারবো ১৯৮২ সাল থেকে পদুয়ার জামিয়াতুল আনওয়ার হেমায়তুল মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের পাশাপাশি বাংলাদেশ নেজামে ইসলামী পার্টির আমীরের দায়িত্বও সামলাচ্ছেন মাওলানা মুহাম্মদ সরওয়ার কামাল আজিজী! সাতকানিয়া সদরের বিখ্যাত জমিদার বাড়ি বহদ্দর বাড়ির সন্তান মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ চৌধুরীর জীবনী না পড়লে কি এই প্রজন্ম জানতে পারবে যুদ্ধকালীন উক্ত বাড়িতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সংখ্যাঘুদের আশ্রয়, ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় দুস্থদের খাবার বিতরণের কথা! লোহাগাড়া ইউনিয়নের মোস্তাফিজুর রহমানকে আমরা জানি সমাজসেবক ও জমিদারপুত্র কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে। কিন্তু তার জীবনী থেকে আরো জানতে পারছি– লোহাগাড়া এক সময় সাতকানিয়া উপজেলার অধীনে ছিল। ১৯৮১ সালে আলাদা থানা হয়। ১৯৮৩ সালে হয় উপজেলা। দুটোতেই ভূমিকা রাখেন মোস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের প্রথম দৃষ্টিবিহীন আইনজীবী খাগরিয়ার এডভোকেট খাদেমুল ইসলামকেও চেনা যাবে এতে। আধুনগরের মাওলানা কাজী নাছির উদ্দিনের প্রখর স্মৃতিশক্তি উঠে এসেছে এভাবে– ‘তিনি কোনো বিষয় বা কোনো কবিতা একবার শুনলে আর ভুলতেন না।” জীবনীতে উল্লেখ আছে আমিরাবাদের ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আইয়ুব ছোটবেলা থেকেই প্রতি রাতে মা–বাবার মঙ্গল কামনায় দুই রাকাত নফল নামাজ বাদ দেননি। জানতে পারলাম যৌতুকের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার মাওলানা গোলাম রসূল কমরী বিগত ৪৫ বছরে কোন বরযাত্রী হিসেবে বিয়ের খাবারই খাননি! একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাওলানা নিজাম উদ্দিন বরযাত্রী হন না, যে বিয়েতে যেীতুক থাকে সে বিয়ের আকদ পড়ান না, ওয়ালিমায় যান, মাহফিলে হাদিয়া নেন না–এসব শিক্ষণীয় বিষয়াবলী ফুটেছে দারুণভাবে।
উঠে এসেছেন বৃহত্তর সাতকানিয়ার অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী সাংবাদিক মাহফুজ উন নবী খোকন। চুনতির সন্তান রেনেসাঁ খ্যাত নকীব খান–এর সঙ্গীতের পাশাপাশি একজন দক্ষ কর্পোরেট ব্যবস্থাপক পরিচয়ও উঠে এসেছে। ব্যবসায়ী পিতা চেয়েছিলেন সন্তান মোহাম্মদ হানিফকে ব্যবসায়ী বানাতে। কিন্তু সিনেমা দেখে তিনি হতে চাইতেন উকিল! তবে সৎ আর সেবার কারবার দেখে প্রাণের তাগিদে হয়ে গেলেন ডাক্তার। আরো জানা গেল, বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ই–লাইব্রেরি চুনতী লাইট হাউজ এর সূচনা করেন দেশের প্রথম নারী চার্টার্ড একাউন্টেট সুরাইয়া জান্নাত লাভলী। কাঞ্চনার বাসিন্দা এশিয়ার সেরা পঞ্চাশজন ব্রান্ড লিডারের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন গীতিকার আসিফ ইকবাল। মাদার্শার প্রত্যন্ত এলাকার পিতামাতা সুন্দর ছেলেটির নাম দিয়ে দিয়েছিলেন কালা মিয়া, যাতে নজর না লাগে! সেই ছেলেটি বুয়েট থেকে পাস করে আমেরিকায় ডক্টরেক্ট করে সে দেশেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। শেক্সপিয়রের উদ্ধৃতির মতো-‘নামে কী আসে যায়, গোলাপকে যে নামে ডাকা হোক না কেন, সে সমান সুগন্ধি দেবে।’ শত ব্যস্ততায়ও অজ পাড়াগাঁয়ে বক্তব্যের ডাক পড়লে জ্ঞান বিতরণ করতে চলে যান চরতির বাসিন্দা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সানাউল্লাহ।
বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় কিছু উদ্ধৃতির মতো বাক্য আছে, এসব জীবনী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির, না লেখকের, না অন্য কারো তা জানালে ভালো হতো। প্রচ্ছদ করেছেন মোমিন উদ্দীন খালেদ। সবমিলিয়ে বইটি পড়া, পড়ানো, সংরক্ষণ এবং ছড়িয়ে দেয়ার মতো।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।