একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, বাংলা নাটকের উজ্জ্বল নক্ষত্র নন্দিত অভিনেতা আলী যাকের। নিপুণ অভিনয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন অনন্য। বৈচিত্র্যময় এমন নানা গুণের কারণে আলী যাকের হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। চট্টগ্রামের নাট্য ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক সংগঠকগণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান, একজন আলী যাকেরের শূন্যস্থান কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন দেশের সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যমণি, সত্যিকার অর্থেই এক নক্ষত্র। তবে তিনি সবচেয়ে বড়ো অবদান রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে।
আপাদমস্তক থিয়েটারের মানুষ ছিলেন তিনি
আহমেদ ইকবাল হায়দার
নাট্য ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, আমরা যখন নাটকে ঢুকি, তখন আলী যাকেরের মতো কিছু মানুষের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। আমাদের জেনারেশনের সৌভাগ্য এই যে, আলী যাকেরের সক্ষম ও খেটে খাওয়া সময়টাকে আমরা দেখেছি। আপাদমস্তক থিয়েটারের মানুষ ছিলেন তিনি। নাট্য নির্মাণে তাঁর দক্ষতা চিল অনবদ্য। আমাকে ‘ইকবাল’ বলে ডাকতেন। তাঁর বোঝানোর ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ২০১৭ সালে আমাদের তীর্যক নাট্য দলের ৪৪ বছর পূর্তিতে ঢাকায় তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। তিনি স্ত্রী সারা যাকেরকে নিয়ে এসেছিলেন। তখন তাঁর শরীরে ক্যান্সার সদ্য বাসা বেঁধেছিল। তাই আমাদের নাটক দেখেন নি। তাঁর স্ত্রী দেখেছিলেন। নাটকের শুরুতে ও শেষে তাঁর সাথে অনেক কথা হয়েছিল। এরপর নতুনভাবে তিনি যখন ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি করলেন, তখন দর্শক সারিতে বসে মঞ্চে তাঁকে দেখেছিলাম। তিনি ও নূর (আসাদুজ্জামান নূর) ভাই অভিনয় করছেন। তখনও তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাই তাঁর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তখনো তাঁর সেই তেজটা ছিল। আজ সকালে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে মনে হলো থিয়েটার কর্মীরা তাদের বিশাল একজন আপনজনকে হারালো।
মঞ্চের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হারিয়ে গেলেন
অসীম দাশ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, ফেইম-স্কুল অব ড্যান্স, ড্রামা অ্যান্ড মিউজিকের নির্বাহী পরিচালক নাট্যজন অসীম দাশ বলেন, বাংলাদেশের মঞ্চের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হারিয়ে গেলেন। এদেশে আমার একমাত্র প্রিয় অভিনেতা ছিলেন আলী যাকের। নূরলদীনের সারা জীবন, গ্যালিলিও-এমন সব নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে মনে হয়, একজন অভিনেতার যা যা গুণাবলী থাকা দরকার তার পুরোটাই আলী যাকেরের ছিল। তিনি মঞ্চে উঠলে মনে হতো পুরো মঞ্চটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তিনি অভিনয় করতেন, চরিত্রের মধ্যে এতটাই নিবেদিত ছিলেন তিনি। আমাদের সৌভাগ্য আমরা তাঁকে দেখেছি, তাঁর কর্মযজ্ঞকে দেখেছি। আমাদের পরের প্রজন্মের দুর্ভাগ্য তারা তাঁকে পায় নি। তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা।
স্বাধীন বাংলা বেতারের অকুতোভয় শব্দসৈনিক
সাইফুল আলম বাবু
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু আলী যাকেরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, তিনি এ উপমাহাদেশের একজন অগ্রজ নাট্য নির্দেশক, নাট্য নির্মাতা এবং অভিনেতা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন অকুতোভয় শব্দ সৈনিক আলী যাকের। তাঁর অভিনয় আমরা টেলিভিশনে দেখেছি, মঞ্চে দেখেছি। এই করোনা কালে আমরা একের পর এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের হারিয়ে ফেলছি। আলী যাকেরের মতো মানুষের শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে সেটাই ভাবনার বিষয়। সকালে খবরটি পাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শেষবার অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সদরুল পাশা স্মারক দিয়েছিলাম আলী যাকেরের স্ত্রী আরেক নাট্য ব্যক্তিত্ব সারা যাকেরকে। সেই সময় তিনিও চট্টগ্রামে এসেছিলেন। নাট্য প্রেমীরা তাঁর কাছে ঋণী।
প্রগতিশীল আন্দোলনেও ছিল অনন্য ভূমিকা
শীলা দাশগুপ্তা
সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্তা বলেন, আলী যাকের ছিলেন একজন বলিষ্ঠ অভিনেতা। দুর্ভাগ্য এই মাসে আমার দু’জন প্রিয় নাট্য ব্যক্তিত্বকে হারালাম। একজন ওপার বাংলার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আর আজ হারালাম আলী যাকেরকে। ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন সদস্য ছিলেন তিনি। প্রগতিশীল আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর মৃত্যু নাট্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। আরেকটা বড়ো বিষয় হলো, আলী যাকেরের পুরো পরিবার সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ভূমিকা রেখে চলেছেন। যেমন রামেন্দু মজুমদারের পরিবার। প্রতিটি পরিবারেই এ চর্চাটা হওয়া উচিত। এ চর্চাটা হচ্ছে না বলেই আমরা একটা প্রজন্মকে হারাতে বসেছি। তিনি শুধুই একজন অভিনেতা কিংবা নাট্য নির্দেশকই ছিলেন না, সমাজ বিনির্মাণের নেপথ্য নায়কও ছিলেন।