আওলাদে রাসূল রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরিকত আল্লামা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হির সাথে ১৯৪৬ সালে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের বার্মায় মোলাকাত হয়। তখন ছিরিকোট হুজুর সেখানে একটা মসজিদে ইমামতি করতেন, যা বাঙালি মসজিদ হিসেবে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে বস্ত্রব্যবসায়ী হালিশহর নিবাসী আবুল বশর কো–অপারেটিভ ও ‘চিটাগাং আরবান কো–অপারেটিভের সেক্রেটারি আবদুল জলিল–সহযোগে হুজুরকে চট্টগ্রাম আনেন। সে হিসেবে প্রথম খানকাহ কোহিনূর মঞ্জিল (১৯৩৮)। সেই থেকে বাংলাদেশে ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’র যাত্রা শুরু। ‘আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ উপমহাদেশের সমৃদ্ধ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হির বাণী ছিলো, ‘মুঝে দেখনা হ্যায় তো মাদরাসাকো দেখো’। পরবর্তীতে এই খানকাহ বলুয়ার দিঘিরপাড়স্থ নুর মোহাম্মদ আল কাদেরির বাসভবনে স্থানান্তরিত হয়। পরে আরো বড় পরিসরে ষোলশহর জামেয়া মাদরাসা সংলগ্ন আলমগীর খানকাহ্ স্থাপিত হয়।
সীতাকুণ্ডে আমার কর্মস্থলে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন দেখলাম আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস–প্র্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মহসিন ইন্তেকাল করেছেন। তার এই মৃত্যু আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তিনি চাইলেই পৈতিৃক সূত্রে বা নিজে দেশের ট্রেডার বা ক্ষমতাসীন ব্যবসায়ী ব্যক্তি হতে পারতেন। কিন্তু তিনি আল্লাহর, রাসূলের এবং জামেয়ার নগণ্য খাদেম হয়েই রইলেন। জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবীর মাসে, হুজুর কেবলাদের চট্টগ্রাম নগরীতে উপস্থিতির সময় ইন্তেকাল করলেন। সূত্রমতে, তিনি দীর্ঘদিন যাবত সিনিয়র ভাইস–প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনজুমান ও জামেয়ার খেদমত করেছেন। এছাড়া জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়াসহ ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশে মাদরাসা এবং তার সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব তিনি সার্বক্ষণিকভাবে পালন করেছেন। সামপ্রতিক বছরগুলোতে আমি লক্ষ্য করেছি ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্য তিনি প্রায়ই হাঁটতেন এবং ঘর্মাক্ত হয়ে আনজুমান অফিসে যেতেন। করোনাকালীন ফ্রন্টিয়ার হিসেবে গাউসিয়া কমিটির যে অবদান তা আমি দুই কিস্তিতে দৈনিক আজাদীতে লিখেছিলাম। এর প্রেক্ষিতে মহসিন ভাইয়ের সাথে আমার টেলিফোনে আলাপ হতো। তিনি বলতেন, ‘আমরা অচিরেই একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল তৈরি করব। যেখানে সকল রোগব্যাধির চিকিৎসা পাবে সুন্নি মুরিদান ভাইয়েরা। আমাদের আলাপ আলোচনায় রেলওয়ে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য জায়গাও দেখছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ হলো না। সর্বশেষ এডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার মারফতে জানা গেল যে, ‘আন্তর্জাতিকভাবে একটি আন্তর্জাতিক চ্যারিটি ফান্ড গঠন করা হয়েছে যা লন্ডনে রেজিস্ট্রার্ড হবে এবং এখান থেকে সেবা করা হবে।’ আমরা আশা করব বর্তমান নেতৃত্ব মহসিন ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল চট্টগ্রামে তৈরি করবেন।
আমার জানামতে, আনজুমানের লিডারশীপ এর মধ্যে ছিলেন আলহাজ্ব মহসিন সাহেবের পিতা নুর মোহাম্মদ আল–কাদেরি, উজির আলী সওদাগর, আলহাজ্ব আমিনুর রহমান, আকরাম খান, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম.এ. মালেকের পিতা দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এবং তাঁর ভাই চাচা, শিল্পী আহমেদ নেওয়াজ এর বাবা আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি আমাকে পিতৃস্নেহ করতেন। তার সাথে জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব আব্দুল ওয়াহাব। ট্রেজারার ছিলেন পদ্মা অয়েল এর সাবেক কর্মকর্তা ডাক্তার এম.এ. হাশেম (কবি ও যুগ্মসচিব মানজুর মোহাম্মদ এর শ্বশুর)। পরে বন্দর এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব মোহাম্মদ জাকারিয়া সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন। দিদার মার্কেটস্থ আনজুমান অফিসে আমি লক্ষ্য করেছি তিনি দানবাক্সের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র আমার ছাত্র আবুল মহসিন মুহাম্মদ ইয়াহিয়া এখন জামেয়া গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান।
সূত্রমতে, প্রথমে নুর মোহাম্মদ আল–কাদেরির বড় ছেলে মোহাম্মদ হাসানকে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর অপারগতা স্বীকার করলে মোহাম্মদ মহসিনকে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। মহসিন ভাইয়ের জানাজা পূর্বে স্মৃতিচারণের সময় আমার জামেয়ার অনেক কলিগ যারা এখন বড় আলেম হয়েছেন। তার মধ্যে সাবেক অধ্যক্ষ মুফতি মুহাম্মদ অছিয়র রহমান, মাওলানা সোলায়মান আনসারি, প্রধান ফকিহ্ আব্দুল ওয়াজেদ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। আব্দুল ওয়াজেদ বলেছেন, ‘মহসিন সাহেব যখন দায়িত্ব নিচ্ছিলেন তখন তিনি নবীন যুবক। তাদের ব্যবসা বাণিজ্য যৌবনদীপ্ত জীবন দিয়ে অনেককিছু করতে পারতেন। কিন্তু সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পরে তার আচার–আচরণ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল’।
জামেয়ার খেদমত: দীর্ঘদিন ঐহিত্যবাহী এশিয়াখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার খেদমত করেছিলেন। এটাকে তিনি ইবাদত হিসেবে মনে করতেন।
তরিকতের শায়খদের সান্নিধ্যে: আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসিন সাহেব সিরিকোট শরিফের হযরাতে কেরামদের নিকট খুবই স্নেহ প্রিয় ছিলেন। হুজুর কেবলার দরবারে সবচেয়ে বেশি তিনিই গিয়েছিলেন। সেটা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
জশনে জুলুছ: ১৯৭৪ সালে আওলাদে রাসূল আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নির্দেশক্রমে বলুয়ারদিঘির খানকায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া হতে সর্বপ্রথম জশনে জুলুছ ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হয়। এর নেতৃত্ব প্রদান করেন আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ সওদাগর আল কাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার আওলাদে রাসূলের অনুপস্থিতিতে আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসিন সাহেবের নেতৃত্বে পবিত্র জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে করোনা কালীন আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসিন সাহেবের ছদারতে ঐতিহাসিক জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পন্ন হয়েছিল। এটা হুজুর কেবলার সুনজরে সম্পন্ন হয়েছিল। শুধু তাই নয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের যত কর্মসূচী পালন করা হত সব অনুষ্ঠানে মহসিন সাহেবের পক্ষ থেকে এবং আনজুমানের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করতেন।
সুন্নিয়তের খিদমত: আহলে সুন্নত সম্মেলন সংস্থার ব্যবস্থাপনায় ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক সুন্নি সম্মেলনে তাঁর গঠনমূলক ভূমিকা সত্যিকার অর্থে প্রশংসনীয়। তিনি আনজুমান ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সম্মেলন সফল করার জন্য জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদানের মধ্য দিয়ে যে সফলতা কামনা করতেন, এটা তাঁর আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ছিল।
আ’লা হযরত শাহ আহমদ খান ফাজেলে বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হির স্মরণে আ‘লা হযরত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিবছরের আলা হযরত সুন্নী কনফারেন্সে তিনি ব্যাপক ভূমিকা পালন করতেন ও সার্বিক সহযোগিতা করতেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সকল সংস্থাকে আন্তরিকভাবে মহব্বত করতেন ও সহযোগিতা প্রদান করতেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসিন সাহেবের অবদান অনস্বীকার্য। কারণ সে সময় ছাত্রসেনার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সভা, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বলুয়ার দিঘি খানকাহ শরীফ ছিল একদিকে নিরাপদ স্থান অপরদিকে থাকা খাওয়া সবকিছুই ছিল এ খানকাহ শরীফে। চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে মুসল্লি পরিষদের পক্ষ থেকে আহলে বায়তে রাসূল স্মরণে ঐতিহাসিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিলে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। সুন্নিয়তের পরিপন্থি কোন বাতিলের সাথে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আপসহীন ছিলেন। গাউসিয়া কমিটি, আনজুমান, জামেয়া বিদ্বেষী কোন ব্যক্তির নিকট মাথানত করেননি। সে যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন। তিনি সর্বস্তরের সুন্নি জনতার প্রতি আন্তরিক ছিলেন।
বর্তমানে আনজুমান ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব মনজুরুল আলম মনজু উপমহাদেশের শীর্ষ সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এটা তাঁর জন্য আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের খিদমত করার একটা অপূর্ব সুযোগ। আমরা আশা করব, তাঁর নেতৃত্বে আনজুমান ট্রাস্ট ও তার অন্তর্ভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠান; সবকিছুতেই একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবেন। মহসিন সাহেব যে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা যেন বাস্তবায়িত হয়। এছাড়াও তাঁর আরেকটি স্বপ্ন ছিল ‘মাসিক তরজুমান’কে দৈনিকে রূপান্তর করার সেটিও আশা করি বাস্তবায়ন করবেন। আমরা নবীন নেতৃত্বকে মোবারকবাদ জানাই। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল সহায় হোন।
দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন হুজুর কেবলাগণের অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসিন সাহেব। তাই তো সাজ্জাদানশীন পীর সাহেব কিবলা হুজুর সাবির শাহ্ (মু.জি.আ.)’র সামনেই পবিত্র আলমগীর খানকা শরীফে ওফাত বরণ করেন তিনি। আনজুমান–জামেয়ার এ নিরলস খেদমতগার, কর্মবীর, আশেকে রাসূলের প্রথম ওফাতবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন মাশায়েখ হযরাতে কেরামের ওসিলায় তাঁকে জান্নাতের আ’লা মাক্বাম নসীব করুন। আমিন।
লেখক: কবি–প্রাবন্ধিক, নির্বাহী সম্পাদক–মাসিক তরজুমান।











