অর্থনীতিবিদদের মতে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল নাজুক। ধীরে ধীরে নানা নীতি-পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন মোটামুটি একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। কৃষি খাতে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ ও প্রবাসী আয়েও অর্জন করেছে মাইলফলক। পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে গতি পেয়েছে শিল্পায়ন। সব মিলিয়ে কর্মসংস্থান বেড়েছে। এখানে বড় ভূমিকা পালন করেছে বেসরকারি খাত। রাষ্ট্রীয় শক্তির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এ ক্ষেত্রে বড় নির্ণায়ক।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ৫০ বছরের যাত্রা: অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ঘটনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভাতেও বক্তারা দেশের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আর্থিক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, ক্ষুদ্রঋণ ও প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। পোশাক খাতের অর্জনও কম নয়। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা ও মানসম্মত শিক্ষার উন্নয়নে খুব ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করতেও বাংলাদেশ সফল হয়নি। আর আর্থিক খাতে সুশাসন আনা এখন বড় বিষয়।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতিতে যত বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে প্রবাসী আয় ও পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধির কারণে খারাপ পরিস্থিতি কিছুটা উতরানো গেছে। উন্নতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, বৈষম্য একটা বড় সমস্যা। কম কর সংগ্রহে অর্থমন্ত্রীও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের হার ভারতের চেয়ে কম। স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। অন্যদিকে দরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারেরও গুণগত মান। প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ৫ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথাও চিন্তা করা যেতে পারে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আর্থিক অগ্রগতি হলেও এ খাতে সুশাসন এখন বড় বিষয়। অন্যদিকে যেকোনো সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচন। এ ব্যাপারে একটি ধারণা চলে এসেছিল। আমার মনে হয়, সমাজের জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার গুণগত উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি।’ দেশের অর্থনীতির নানা সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা এখনো কাটেনি বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গেল কয়েকমাসে তা আরো বেড়েছে।
আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, গত এক দশকে এবারই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি সবচেয়ে চাপে আছে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত আছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, ‘আর্থিক খাতে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।’ তার মতে, ‘ঋণ নিয়ে ফেরৎ দিচ্ছে না ঋণগ্রহীতারা এবং দিনে দিনে টাকার অংকটা বড় হচ্ছে। যা অর্থনীতির জন্য বড় চাপ।’ তবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট হয় না বলেও জানান তিনি।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই একটি দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য গড়ে ওঠে। এতে বৃদ্ধি পায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সম্ভব হয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কাজেই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ব্যাংককে বলা হয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। লাখ লাখ সঞ্চয়ী মানুষের ভরসা হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আর্থিক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। এ খাতের আওতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অর্থ জমা, লেনদেন, আন্তর্জাতিক বিনিময় ও লেনদেন, আমদানি-রপ্তানি, বিভিন্ন ধরনের ঋণসেবা প্রদান, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, এসএমই-এর উন্নয়নসহ নানাবিধ কার্যক্রমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। সামাজিক দায়বদ্ধতায়ও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা প্রশংসনীয়। হাসপাতাল-ক্লিনিক নির্মাণ, মেধাবৃত্তি প্রদান, হাসপাতালে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছে। মোট কথা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের সব ধরনের আর্থিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র আশা-ভরসার স্থান। তাই এ খাতে আরো অগ্রগতি প্রয়োজন।