সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের আলোচিত বিষয়গুলোর একটি কিশোর অপরাধ। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট-বড় যেসব কিশোর অপরাধের ঘটনা ঘটছে, তা ভবিষ্যতের জন্য স্পষ্টতই হুমকিস্বরূপ। পরিণত বয়সের অপরাধীরা যে অবস্থান থেকে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে, তাদের সঙ্গে রয়েছে কিশোর অপরাধীদের পার্থক্য। তার নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
গতকাল ২৪ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, নানা উদ্যোগে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে না আসায় আবারও মাঠে নেমেছে পুলিশ। মাদক, ছিনতাই কিংবা খুন- চট্টগ্রামে এমন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আছে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। যাদের পেছনে আছে বড় ভাই নামে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। ‘কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আবার মাঠে পুলিশ, তালিকার পাশাপাশি চলছে অভিযান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল এক বছরে কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হয়েছে অন্তত ১০ জন। মামলা হয়েছে শতাধিক ঘটনায়। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে গত বছর নগরীর ১৬ থানায় ৫৩৫ জন কিশোর গ্যাং সদস্য এবং শেল্টারদাতা ৪৭ জন কথিত গডফাদার বা বড় ভাইয়ের তালিকা করেছিল পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার ফলে পুলিশ আর এগোয়নি। তবে সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে গত ৩ অক্টোবর থেকে নগরীর ১৬টি থানার ১৪৫ জন বিট কর্মকর্তা কিশোর গ্যাং ও তাদের মদদদাতাদের (গডফাদার) তালিকা তৈরি করছেন। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।
ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে কিশোরের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির বেশি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ। কিন্তু দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ও নৈতিক চর্চার অভাব, অবাধ স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ, আকাশ-সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের আগ্রাসন প্রভৃতি সব কারণে বাড়ছে কিশোর অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা- এ অভিমত সমাজবিজ্ঞানীদের। তাঁদের মতে, খেলাধুলার সুযোগ কমে যাওয়া এবং বয়স-উপযোগী সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিনোদনের পরিবেশ ক্রমেই সংকুচিত হওয়ার প্রভাবও কম নয়। সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার বিষয় হলো, ক্রমেই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়া। বিস্তৃত হচ্ছে তাদের সংঘবদ্ধ অপরাধপ্রবণতা। বড়দের সঙ্গে অসদাচরণ, সহপাঠী কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি, তীব্র গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, অশ্লীলতা, ইভটিজিং ও ছিনতাইয়ের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছে খুন ও ধর্ষণের মতো দুর্ধর্ষ সব অপকর্মে। আবার ধূমপান ও মাদক সেবনের সঙ্গে সঙ্গে মাদক ব্যবসার সঙ্গেও বাড়ছে কিশোর অপরাধীদের একাংশের সংশ্লিষ্টতা। ‘প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা’র কারণটি বর্তমান সময়ে কিশোর অপরাধের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। কেননা, কিশোর অপরাধ প্রবণতা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ফেসবুকের মাধ্যমে গ্রুপ তৈরি করে নানা অপরাধ করছে তারা। কোনো অপরাধের পেছনে শুধু একটি কারণ দায়ী থাকবে তা কিন্তু নয়, একের অধিক কারণও থাকতে পারে। পারিবারিক কারণের সঙ্গে থাকতে পারে অর্থনৈতিক কারণ, আবার অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে থাকতে পারে রাজনৈতিক কারণও।
অপরাধবিজ্ঞানীরা বলেন, চারপাশের অস্থিরতা কিশোরদের মনকেও অস্থির ও অপরাধপ্রবণ করছে। তাই তাদের পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি যথাযথ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আলোয় আনা জরুরি। তাদের মানবিক, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তার চর্চাও। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা, অন্যায় ও নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তার মনোজগতকে যেন বিশৃঙ্খল করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিশোর অপরাধ দমনের দায় কেবল পরিবার বা রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারহীন তথা ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের স্থায়ী পুনর্বাসন নিশ্চিতেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবারে থেকেও যেসব শিশু-কিশোর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকাই প্রধান। সন্তানদের স্বাধীনতা দেওয়া মানে তাদের ইচ্ছামতো চলাফেরা করার সুযোগ অবারিত করে দেওয়া নয়। তারা বাইরে কতক্ষণ থাকছে এবং কাদের সঙ্গে মিশছে তা পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথ মসৃণ করতে হবে। তাদের পেছনে যেসব বড় ভাই কাজ করছে, তাদেরকেও চিহ্নিত করতে হবে।