সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকারের এক দৈত্য। শোঁ শোঁ করে সাগরের পানি পান করছে। এক সময় সাগরের সমস্ত পানি শুষে নিল দৈত্যটি। পানি শূন্য সাগর জুড়ে পড়ে রইল শুধু বালি আর লবণ। যে দিকে চোখ যায় ধু ধু বালি আর জায়গায় জায়গায় লবণের স্তূপ। রূপকথায় এমন গল্প তোমরা নিশ্চয়ই পড়েছো। বাস্তবেও যে মানুষ সাগর শুকিয়ে ফেলতে পারে আজ তার গল্পই বলবো তোমাদের। তোমাদের চোখ নিশ্চয়ই কপালে ঠেকেছে? সাগর আবার শুকায় কীভাবে? তাও আবার মানুষের দ্বারা?
তাহলে শোনো। মধ্য এশিয়ার দু’টি দেশ হচ্ছে কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তান। এ দেশ দু’টির মাঝখানে ছিল বিশাল এক হ্রদ। আরল সাগর তার নাম। বিশালতার কারণে আরবরা আরলকে সাগর নামেই নামকরণ করে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আরল সাগরটি ছিল পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম হ্রদ। এটি উত্তর আরল, দক্ষিণ আরল এবং আরো কিছু ছোট ছোট হ্রদের সমন্বয়ে গঠিত। এর জন্ম ৫৫ লক্ষ বছর আগে।
তোমরা জেনে অবাক হবে যে আরল সাগর সমুদ্র সমতল হতে ৫৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তোমরা হয়তো ভাবছো হ্রদ কীভাবে সাগর হলো, তাই না? ঠিকই ধরেছো। হ্রদটি এত বিশাল ছিল যে এটি সাগর নামেই পরিচিতি পায়। ভাবছো কত বিশাল ছিল সাগরটি। এটি ছিল উত্তর–দক্ষিণে ৪৩৫ কিলোমিটার লম্বা আর প্রস্থ ছিল পূর্ব–পশ্চিমে ২৯০ কিলোমিটার। এর আয়তন ছিল ৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটার, বাংলাদেশের আয়তনের অর্ধেকের একটু কম। বেশি গভীর ছিল না সাগরটি। কোথাও কোথাও ১৬ মিটার, কোথাও আবার ৬৯ মিটার। এক সময় দু’টি নদীর পানিতে পুষ্ট হয়ে আরলে থই থই করতো নোনা পানি। স্টার্জন, কার্প, বারবেল, রোচ ও অন্যান্য জাতের মাছ বিচরণ করতো আরলের পানিতে। আশপাশের জেলেরা সেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। ছোট ছোট মৎস্য শিল্প গড়ে উঠেছিল আরলের তীরে। মানুষ দল বেঁধে বেড়াতে যেত সাগর তীরে। কেউ কেউ নৌকা বা বোটে চড়ে উপভোগ করত ভ্রমণ কিন্তু এখন দেখা যায় বালির উপর দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট জাহাজ আর হরেক রকমের মাছ ধরার বোট। সাগর শুকিয়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা। ফলে দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। লবণ এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ যেগুলো এক সময় আরলের পানিতে দ্রবীভূত ছিল সেগুলো এখন বায়ুবাহিত হয়ে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর হুমকি সৃষ্টি করছে।
১৯৯০ সালের দিকে আরল কেন্দ্রিক মৎস্য শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। আগে আরলের পানিতে লবণ ছিল প্রতি লিটারে ১০ গ্রাম। বর্তমান আরলের পানিতে লবণের পরিমাণ কতো জানো? অন্যান্য সাগরে যে পরিমাণ লবণ থাকে তার প্রায় তিন গুণ, প্রতি লিটারে ১০০ গ্রাম। এই পরিমাণ লবণ যেকোনো প্রাণীর বসবাসের জন্য অনুপযোগী। ধূলিঝড় এবং লবণের কারণে বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করে অঞ্চলটিতে। শীত এবং গরম উভয়ই আগের তুলনায় চরম।
হয়ত ভাবছো, কীভাবে শুকালো আরল সাগর। আরলের পানির উৎস হচ্ছে আমু দরিয়া এবং সির দরিয়া নামের দু’টি নদী। তোমরা হয়তো জানো মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে বৃষ্টিপাত কম হয়। বছরে মাত্র ১০০ মিলিমিটার। পর্বতের বরফ গলা পানিই নদী দু’টির পানির প্রধান উৎস। তৎকালীন সোভিয়েত আমলে তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যে নদী দু’টির পানি তুলা চাষের জমিতে প্রবাহিত করা হয়। তুলা বেশি উৎপাদন হতে থাকল ঠিকই কিন্তু সাগরটি গেল শুকিয়ে। ১৯৮০ সালের দিকে নদী দু’টি সাগরে আছড়ে পড়ার আগেই শুকিয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের দিকে অবশিষ্ট থাকে আরলের মাত্র ১০ শতাংশ পানি।
আশার কথা হচ্ছে আরলে পানির প্রবাহ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০৩ সালে কাজাখস্তান সরকার আরলে পানির প্রবাহ বাড়াতে বাঁধ নির্মাণ করে। এর ফলে উত্তর আরল সাগরে পানির পরিমাণ বাড়ে। এখন সেখানে চলছে নৌকা, লঞ্চসহ ছোট ছোট জলযান। বেড়েছে মাছের বিচরণ। জেলেরাও মাছ ধরতে পারছে কিন্তু দক্ষিণ আরল এখনও পানির সংকটে ভুগছে। যত উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক না কেন আরলকে হয়ত এর আগের অবস্থায় আর কখনই ফিরে পাওয়া যাবে না।