নরম রোদের এক সকালে, ছোট্ট মেয়ে আরজু উঠানে খেলা করছিল। আরজু ছিল খুব কৌতূহলী আর মিষ্টি স্বভাবের। প্রতিদিন সে গাছের পাতাগুলো নেড়ে দেখে, কোন পাখি বাসা বানিয়েছে কিনা। রোদ্দুরের ঝিলিক পছন্দ করে, আর দৌড়ে বেড়ায় মুরগি আর বিড়ালের পেছনে পেছনে। উঠান ছিল যেন তার এক ছোট্ট রাজ্য।
তার মা প্রতিদিন রান্না শেষ করে চুলার ছাই উঠানের একটা কোণায় রাখতেন। সেই ছাই আরজুর জন্য খুবই সাধারণ জিনিস ছিল না খেলার, না দেখার কিছু। একদিন সকালে রান্না শেষে মা আবার ছাই তুলে রেখে দিলেন উঠানের এক কোণায়। আরজুর খেয়াল ছিল না সেদিকে। সে তখন পাতা কুড়োচ্ছিল, ছোট ছোট পোকা দেখছিল।
হঠাৎ করে একটা কাক ‘কা কা’ করে উড়তে উড়তে নামল ছাইয়ের দিকে। ছাইয়ের পাশে কোনও খাবারের টুকরো ছিল, হয়তো সেই গন্ধেই কাকটি সেখানে এসেছে। কিন্তু কাকটি জানত না, ছাইয়ের নিচে তখনো আগুনের তাপ লুকিয়ে আছে। কাকটি ছাইয়ের ওপর নামতেই, তার পা যেন আগুনে পুড়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গে সে ছটফট করে উঠল, ডানার কয়েকটা পালক পুড়ে গেল, আর সে উড়তে উড়তে একেবারে টিনের চালে গিয়ে বসলো।
এই দৃশ্য দেখে আরজু হতভম্ব! সে দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল,
“আব্বু! কাকটা ছটফট করছে! দেখো না, ও কেমন করে বসে আছে চালে!”
বাবা বললেন, “তুমি ভয় পেয়ো না, মা। আমি গিয়ে দেখছি।”
বাবা দৌড়ে গিয়ে কাকটিকে চালে থেকে নামালেন। কাকটা তখন খুব কষ্টে ছটফট করছিল। তার ডানার এক পাশে পাখনা ঝলসে গেছে। পা–ও লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। আরজু তো এমন অবস্থা কখনো দেখেনি! তার বুক ছোট্ট বুকটা ধুকধুক করতে লাগল। বাবা খুব যত্ন করে কাকটাকে সেবা করতে লাগলেন। গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করলেন, ঘরোয়া মলম লাগালেন। তারপর পুরনো খাঁচা এনে কাকটাকে রাখলেন যাতে সে নিরাপদে থাকতে পারে।
সন্ধ্যায়, মা রান্না শেষ করে বসেছিলেন। আরজু গিয়ে বলল,
“মা, কাকটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওর পা পুড়ে গেছে। তুমি কেন ছাই রেখে দাও উঠানে? যদি আমার পা যেতো ওখানে?”
মা একটু চুপ করে থাকলেন। ছোট্ট মেয়েটার চোখে জল। মা বুঝলেন, আরজু ভেতর থেকে কষ্ট পেয়েছে।
“মা,” আরজু আবার বলল, “তুমি জানো, এমন আগুন বাতাসে ছড়িয়ে গেলে অন্য ঘরের চালাও পুড়ে যেতে পারে!”
মা এবার বললেন,
“তুই ঠিক বলেছিস। আমি বুঝিনি এতটা বিপদ হতে পারে। তোকে কথা দিচ্ছি মা, আজ থেকে আর কখনো আগুনের ছাই উঠানে ওভাবে ফেলে রাখবো না। যদি ফেলিও, আগে পানি দিয়ে নিভিয়ে ফেলবো। আমাকে ক্ষমা করে দে মা।”
আরজু মুচকি হেসে বলল,
“ঠিক আছে, আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। কিন্তু কাকটা কি ভালো হয়ে যাবে?”
মা কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“আমরা তো সেবা করছি। আল্লাহ চাইলেই ও ভালো হয়ে যাবে।”
দিন পার হলো। আরজু রোজ কাকটাকে দেখতে যেত, কথা বলত।
“তুমি আর কখনো ছাইয়ের ওপর বসবে না, ঠিক আছে? আমি তোমাকে ঠিক করে দেবো!”
কিন্তু পরের দিন সকালে কাকটা আর চোখ মেলেনি। সে মারা গেছে।
আরজু ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। সে ভাবতেই পারেনি কাকটি আর উঠবে না। খাঁচার পাশে বসে বলল,
“তুমি তো আমার বন্ধু ছিলে… আমি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম… আমি তো খারাপ কিছু করিনি।”
বাবা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তুই কিছু ভুল করিসনি মা। বরং তুই একটা জীবের জন্য যা করেছিস, তা অনেক বড় কাজ। মানুষ যদি সব জীবের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখায়, তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হবে।”
আরজু চোখ মুছে বলল,
“আমরা কি কাকটাকে কবর দিতে পারি?”
বাবা বললেন,
“অবশ্যই। আমরা ওকে সম্মানের সাথে বিদায় জানাবো।”
আরজু আর বাবা উঠানের এক কোণে কাকের জন্য ছোট্ট কবর করলো। চারদিকে কিছু ফুল ছড়িয়ে দিলো। আরজু খুদে একটা কাঠের টুকরোতে লিখে দিলো্ত
“আমার প্রিয় কাকবন্ধু”
সেদিন থেকে আরজুর মা ছাই রেখে দিলে আগে পানি ঢেলে দেন। এমনকি আশেপাশের বাসিন্দাদেরও সচেতন করে দেন। মায়ের সচেতনতা দেখে আরজু বুঝে গেল্তভালবাসা আর সতর্কতা থাকলে পৃথিবী আরও সুন্দর হতে পারে। আর ছোটরাও অনেক সময় বড়দের ভালো কিছু শেখাতে পারে! তাই সে মনে মনে ঠিক করল, সব জীবকে ভালোবাসবে, আর কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে সাহায্য করবে।