২০২১ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে দুই ছাত্রীকে হেনস্তার ঘটনায় আরও চার শিক্ষার্থীকে এক বছর করে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পত্র ইস্যুর পরবর্তী এক বছর তাদের বহিষ্কার কার্যকর হবে বলে জানান প্রশাসন। বহিষ্কৃতরা সবাই শাহ আমানত হলে অবস্থান করতো এবং শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারী বলে জানা যায়। এছাড়া যৌন নিপীড়ন সেলে জমা হওয়া আরও দুইটি অভিযোগের রায় দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে ফরেস্ট্রি ইনস্টিটিউটে এক ছাত্রীর সঙ্গে অশোভন আচরণের দায়ে একই বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর এ টি এম রফিকুল হককে ও অন্য একটি ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রকে লিখিতভাবে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।
গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে বারোটায় উপাচার্য দফতরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর বেনু কুমার দে উপস্থিত ছিলেন।
বহিষ্কৃতরা হলেন- ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের জান্নাতুল ইসলাম রুবেল, দর্শন বিভগের মো. ইমন আহম্মেদ ও রাকিব হাসান রাজু এবং আরবি বিভাগের জুনায়েদ আহমেদ। চারজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক উপগ্রুপ সিএফসির অনুসারী।
প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান বলেন, যৌন নিপীড়ন সেলে থাকা তিনটি অভিযোগের সুরাহা করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীর অভিযোগে অভিযুক্তদের লিখিতভাবে সতর্ক করা হয়েছে।
এছাড়া যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দুই ছাত্রীকে হেনস্তার ঘটনায় অভিযুক্ত ৪ জনকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের দুই ছাত্রী হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন।
ভুক্তভোগীর ভুল তথ্যে শনাক্তে দেরি : হেনস্তার শিকার ছাত্রীর দেওয়া তথ্যে ভুল থাকায় ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে দেরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া। গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই তথ্য জানান। প্রক্টর বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তার অভিযোগে প্রথমে বলেছিল যে তাকে প্রীতিলতা হলের পাশ থেকে অভিযুক্তরা টেনেহিঁচড়ে আড়ালে নিয়ে যায়। কিন্তু তদন্ত চলাকালে সে জানিয়েছে, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পেছনের গলি বা ছোট রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় বন্ধুসহ বসেছিল। পরে সেখানে গিয়ে অভিযুক্তরা তাদের মারধর ও অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রীতিলতা হল থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। তার পেছনে ছোট একটি পাহাড়ি রাস্তা ও জঙ্গলের পর ওই ফাঁকা জায়গার অবস্থান। কিছুটা ভেতরে হওয়ায় ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। প্রক্টর আরও বলেন, ঘটনাস্থল মূল রাস্তা থেকে ভেতরে হওয়ায় সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। ফলে আমাদের কিছুটা দূরের প্রীতিলতার হলের দুইপাশের রাস্তায় থাকা ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করতে হচ্ছে। আর স্টেটমেন্ট ভিন্ন হওয়ায় দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করতেও দেরি হয়েছে।
মূল ঘটনা : গত ১৭ জুলাই রাত দশটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতার হলের পাশে এক ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগ ওঠে অজ্ঞাত পাঁচ যুবকের বিরুদ্ধে। ওই সময় ভুক্তভোগী ও তার এক বন্ধুকে ঘণ্টাখানেক আটকে রেখে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে বলে তারা জানান। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় অজ্ঞাতনামা ৫ জনকে আসামি করে একটি মামলাও করেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ঘটনার বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি জানানো হয়। পরে গত শুক্রবার রাতে ও শনিবার বিকালে অভিযুক্ত ৫ জনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় র্যাব-৭। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকা দুই শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ক্যাম্পাস নিরাপদ আছে বললেন উপাচার্য : চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেন, দৃঢ়তার সঙ্গে জানাতে চাই, বর্তমান প্রশাসন এই ক্যাম্পাসে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। আর সবার জন্য ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ নিরাপদ। তিনি জানান, ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাস্তা ও স্থাপনায় পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও নিরাপত্তা প্রহরীদের ডিউটি পালাক্রম বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ছাত্রী হেনস্তার মতো এ অনভিপ্রেত ঘটনার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে চবি প্রশাসন নজির স্থাপন করেছে। ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সজাগ থাকবে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।
শিক্ষার্থীদের চার দাবিতে প্রশাসনের সংহতি : শিক্ষার্থীদের দেয়া চার দফা দাবির বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করে সংবাদ সম্মেলন করেছে চবি কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের বেঁধে দেয়া চার দিনের আলটিমেটামের মাঝেই দাবিগুলোর সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শিক্ষার্থীদের চারটি দাবির মধ্যে প্রথমটি ছিল- ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিতে হবে। মেয়েদের হল থেকে বের হওয়া বা ঢোকার এবং মেডিক্যালে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সময়সীমা তুলে নেয়ার নির্দেশনা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল ভেঙে নতুন কার্যকরী সেল গঠন করতে হবে। বিচার নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সময়সীমা থাকবে এক মাস এবং তা করতে ব্যর্থ হলে সেল স্বয়ং নিজের শাস্তির বিধান করবে। তৃতীয়ত, যৌন নিপীড়ন সেলে চলমান অভিযোগগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে। চতুর্থত, আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি স্বেচ্ছা পদত্যাগ করবেন। এ সবগুলোর ব্যাখ্যা দেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান।