চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মালিকানাধীন নগরের সিঙ্গাপুর–ব্যাংকক মার্কেটে ২০২১ সালে একটি ‘সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ গড়ে তোলে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে আয়ও করছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, ফ্লোর মালিক চসিককে বর্গফুট প্রতি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ পরিশোধ করার কথা হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের। কিন্তু দীর্ঘ ৪১ মাস চসিককে তার প্রাপ্য পরিশোধ করছে না হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।
চসিকের ভূ–সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে গত মে মাস পর্যন্ত ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৮ হাজার ১৭৭ টাকা পাবে। বকেয়া এ টাকা পরিশোধে সর্বশেষ গত ২ জুন হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দাপ্তরিক পত্র দেয় চসিক। অবশ্য এর আগেও দফায় দফায় তাগাদা দেয়া হয়। এদিকে চসিককে প্রাপ্য পরিশোধ না করার বিষয়টিকে চুক্তির ধারা ভঙ্গ ও চুক্তির শর্ত লঙ্ঘণ বলে মনে করেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি আজাদীকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী কর্পোরেশনের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় চুক্তি বাতিল করে আমরা নিজেরাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিব।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী অবশ্যই চসিকের প্রাপ্য পরিশোধ করতে হবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে। এ বিষয়ে উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মিটিং হয়েছে। আমরা পত্রও দিয়েছি।
কী আছে চুক্তিতে : সিঙ্গাপুর–ব্যাংকক মার্কেটে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনে চসিক এবং বাংলাদেশ হাই টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর প্রেক্ষিতে পাঁচটি ফ্লোরে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক গড়ে তোলে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। যা ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয়।
চুক্তির ৭নং শর্ত অনুযায়ী–প্রতি বর্গফুট কমপক্ষে ৩০ টাকা টাকা ভাড়া ধার্য আছে। ভাড়া থেকে ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ২৭ টাকার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ টাকা ৫০ পয়সা পাবে চসিক। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভাড়া কার্যকর হওয়ার কথা। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী–টেকনোলজি পার্ক করার জন্য ৬টি ফ্লোরে ১ লাখ বর্গফুট (কমবেশি) স্পেস করার কথা। তবে বাস্তবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ৮৯ হাজার ২৬৫ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস নির্মাণ করে।
এদিকে চুক্তির বিষয়ে গত ২৭ মে টাইগারপাস নগর ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ে মেয়র দপ্তরে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে চসিকের রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বশীলরা দাবি করেন, চুক্তি অনুযায়ী ১ লাখ বর্গফুটের ভাড়া চসিকের প্রাপ্য।
পরে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বাস্তবতার নিরিখে যাচাই করে যতটুকু ফ্লোর স্পেস আছে তার উপর ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত নেন। মেয়র বলেন, করোনা মহামারী বিবেচনায় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারির পরিবর্তে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চসিকের প্রাপ্য ভাড়া আদায়েরও বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে প্রতি বর্গফুট ভাড়ার বিষয়ে চুক্তির বাইরে কোনো কিছু বিবেচনা করার সুযোগ নেই এবং বকেয়া সম্পূর্ণ পরিশোধ করা হলে নতুন করে চুক্তি সম্পাদন করা হবে।
ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নির্মিত ৮৯ হাজার ২৬৫ বর্গফুট ফ্লোর–এর বিপরীতে চসিকে গত মে মাস পর্যন্ত ৪১ মাসে পাবে ৪ কোটি ৯৪ লাখ ৮ হাজার ১৭৭ টাকা। তবে এর মধ্যে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এক কোটি টাকা পরিশোধ করে। ওই হিসেবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে চসিকের পাওনা আছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৮ হাজার ১৭৭ টাকা।
এছাড়া ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দাবিকৃত টাকা দিতে ব্যর্থ হলে হাইটেক পার্কের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটি বাতিল করে নতুনভাবে অন্য পক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে চসিক।
চুক্তি সংশোধন করতে চায় হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ : গত ১২ মার্চ চসিকেকে পত্র দিয়ে চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব করে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, সিঙ্গাপুর–ব্যাংকক মার্কেটের ৬ষ্ঠ তলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ঊর্ধ্বমূখী সমপ্রসারণ করার পরিবর্তে ৬ষ্ঠ তলা হতে ১০ তলা পর্যন্ত সর্বমোট পাঁচটি ফ্লোর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ফ্লোর সরজমিনে পরিমাপ করে ১৭ হাজার ৮৫৩ বর্গফুট হিসেবে পাঁচটি ফ্লোরের সর্বমোট ৮৯ হাজার ২৬৫ বর্গফুট স্পেস নির্মাণ করা হয়েছে। এ ৮৯ হাজার ২৬৫ বর্গফুট স্পেসের মধ্যে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অফিস ও বিনামূল্যে স্টার্টআপ কোম্পানির জন্য ২১ হাজার ১৩৩ বর্গফুট স্পেস বরাদ্দ রয়েছে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে ৬৮ হাজার ১৩২ বর্গফুট স্পেসের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এতে আরো বলা হয়, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ২৮তম নির্বাহী কমিটির সভায় বর্গফুট প্রতি ভাড়া ৩০ টাকার পরিবর্তে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ১০ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সাড়ে ১৩ টাকার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ টাকা ৭৫ পয়সা হারে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া প্রদানযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত হয়। তাই হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ও চসিকের মধ্যে সরেজমিনে স্পেসের পরিমাণ নির্ধারণ করে ভাড়ার পরিবর্তে রেভিনিউ শেয়ারিং পদ্ধতিতে বাস্তবভিত্তিক হার নির্ধারণসহ চুক্তি সংশোধন বা পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
এদিকে চসিকের এস্টেট বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া প্রদানযোগ্য’ এ ধরনের কোন কথা চুক্তিতে নেই। বরং চুক্তি অনুযায়ী পুরো ১ লাখ বর্গফুটের ভাড়াই প্রাপ্য চসিক।